‘তুমি আমার মনের কথাই বললে, রিয়া!’ সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম। ‘সত্যিই তো! এমন নয় যে তুমি দুঃস্বপ্ন না দেখলে হাসমত সাহেব অ্যাকসিডেণ্ট করতেন না!’
‘এর ঠিক আগের দিন হাসমত আঙ্কেলকে নিয়ে আমাদের বাসায় বেড়াতে এল বন্ধু রুবি। সবচে’ ভয়ঙ্কর ব্যাপার কী জানেন, স্বপ্নের সেই মর্গে যাদের চেহারা দেখেছি, তাদের একজনের সঙ্গে হাসমত আঙ্কেলের চেহারার দারুণ মিল।’
‘কী রকম?’
‘হাসমত আঙ্কেলের বাঁ চোখের নিচে আছে কালচে মত আঁচিল। আকারে অনেকটা পেঁপের বিচির মত। আঙ্কেলের কপালটা একটু উঁচু, চোখদুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার মত স্ফীত। ঠিক এ চেহারার একজন লাশ হয়ে শুয়ে ছিল আমার স্বপ্নের মুর্দাখানায়।’
‘বলো কী! এ-ও কি সম্ভব?’
‘এরপরও আপনি বলবেন আমার স্বপ্নের কোনও মাজেজা নেই?’
মুখে কিছু বললাম না। সন্ত্রস্ত বোধ করলাম। এমনভাবে কথাগুলো বলছে রিয়া, বিশ্বাস না করে উপায় নেই। ‘তারপর বলো, হাসমত সাহেবের কী হলো? উনি দ্রুত সেরে উঠে বাসায় ফিরলেন?’ আমার কৌতূহল ক্রমশ সীমা ছাড়াচ্ছে।
‘নো, স্যর, তা হয়নি। চিকিৎসকের ভুলে হোক বা ওষুধে ভেজালের কারণে, হাসমত আঙ্কেলের পায়ে শুরু হলো পচন। সারা শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল ইনফেকশন। ঠিক পনেরো দিনের মাথায় তিনি মারা যান।’
‘সো স্যাড!’ পাঞ্জাবির খুঁটে চোখ মুছলাম। লোক দেখানো নয়, লেখক হিসেবে আমার সমবেদনা অন্য যে কারও চেয়ে বেশি। জানি, এই অনিশ্চিত দুনিয়ায় গর্ব বা অহঙ্কার করার কিছু নেই। আমরা স্রষ্টার হাতে পুতুল মাত্র।
‘আরেকটু কফি খাবে, রিয়া? গলাটা কেমন শুকনো লাগছে!’
‘না, এর পরের ঘটনাটা শুনুন, আবারও শুরু করল রিয়া। এত সুন্দর গুছিয়ে বলে, চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই উঁচু মানের লেখক হতে পারবে। নিখুঁত ওর বর্ণনা, শব্দচয়নেও লালিত্য আছে।
‘শীতের ছুটিতে কক্সবাজার বেড়াতে গেছি। সঙ্গে বন্ধুরা, কয়েকজন বন্ধুর অভিভাবকও আছেন। মায়েরা ওদের একা ছাড়তে চাননি। খুব শান্তশিষ্ট (!) মেয়ে কি না! তারিখটা…’ রিয়া মনে করে বলল, ‘ডিসেম্বরের ৭, ২০১১। বন্ধুরা সবাই মিলে বেশ হৈ-হুল্লোড়, হাসি-ঠাট্টা চলছে। কলাতলি চ্যানেলে হোটেল ঝাউবনে টাটকা তাজা রূপচাঁদা আর লইট্টা ভাজা খাচ্ছি। কথা ছিল কক্সবাজারে দু’দিন কাটিয়ে আমরা যাব টেকনাফ। তারপর দ্বীপসুন্দরী সেন্ট মার্টিন। কিন্তু আমার আর যাওয়া হলো না। মাঝপথে ফিরতে হলো।’
‘কেন, আবার কোনও বিপদ?’
রিয়া স্কুলগামী মেয়েদের মত ওপরে-নিচে মাথা দোলাল। ‘সেদিন বিকেল থেকেই মনটা ভীষণ কু গাইছিল। বুঝতে পারলাম কিছু একটা ঘটবে। সতর্ক হলাম। বন্ধুদের বললাম, আমার বোধ হয় যাওয়া হবে না। তোরা ভাল করে ছবি তুলে আনিস, পরে দেখব। বন্ধুরা খেপে লাল। আমি নাকি সব কিছুতেই বাগড়া দিই। আমি একটা অপয়া! সব অশুভ ঘটনার বার্তাবাহক। মনে খুব কষ্ট পেলাম। অথচ ওরা মিছে কিছু বলেনি। বিকেল থেকেই প্রচণ্ড মাথাব্যথা, দুঃস্বপ্ন পর্বের আগের স্টেজ। চোখে ঝাপসা দেখলাম আমি। ভাবতে চেষ্টা করলাম, পরিচিত কারও অসুখ করেছে কি না, বা কেউ হাসপাতালে ভর্তি আছে কি না। প্রচণ্ড ভয় পেলাম, না জানি কাকে এবার হারাতে হবে!’
রিয়ার কথা শুনে ভীষণ ঘামতে শুরু করেছি আমিও। সম্মোহকের মত কথা দিয়ে আমাকে যেন বেঁধে ফেলেছে ও। অবাস্তব, অযৌক্তিক, অথচ সত্যি। রিয়া যা বলার, বলছে সত্যি।
‘সে রাতে আর কিছু খাইনি, মানে খেতে পারিনি। মাথাব্যথার তীব্রতা এত বাড়ল যে বমি পেয়ে গেল। দুটো অ্যাসপিরিন খেয়ে আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়লাম। তবে চোখ বন্ধ করিনি, পাছে ঘুম এসে যায়, স্বপ্ন দেখি!’
রিয়ার কণ্ঠে কান্না।
ওর তখনকার অসহায়ত্ব বুঝতে পারছি। অপরের কান্না নিজের চোখে ধরতে না পারলে কীসের লেখক আমি!
রিয়া বলল, ‘শত চেষ্টা করেও ঘুম আটকাতে পারিনি। তন্দ্রা মানেই দুঃস্বপ্ন। এবারের স্বপ্ন একটু অন্যরকম। দেখলাম, আমি ভাসছি সাগরে। ভেলা নাকি কোনও সাম্পান টাইপ নৌকো, ঠিক মনে নেই। ঢেউয়ের দোলায় ভীষণ দুলছি। কোথাও কেউ নেই, আমি একা। এমনকী দাঁড় বা বৈঠাও নেই যে কূলে ফিরব। কাঁদছি ভয়ে, সহসাই শাঁ-শাঁ শব্দে এল ঝোড়ো বৃষ্টি। একাকার হয়ে গেল আমার চোখের জল-বৃষ্টি আর সমুদ্রের লোনা পানিতে। বাতাসে উল্টে গেল ভেলা, হাবুডুবু খেতে লাগলাম আমি।’
‘তারপর? তোমার কী হলো, রিয়া!’ ওর বয়ান শুনে রুদ্ধশ্বাস হয়ে গেছি।
‘রাত তখন বারোটার কম নয়। ভাসছি সাগরে। ঢেউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে ভেঙে গেল ঘুম।
এটুকু বলে রিয়া একটু থামল। পরক্ষণে বলল, ‘না-না, একটু বাকি রয়ে গেছে। সাগরে যখন হাবুডুবু খাচ্ছি, হঠাৎ দেখি দুটো লাশ ভেসে যাচ্ছে আমার পাশ দিয়ে। সাদা কাফনে মোড়া, সম্ভবত বাচ্চার। কফিনের আকার আড়াই ফুটের বেশি নয়। বিশ্বাস করবেন না, স্যর, মুহূর্তে বুঝলাম কারও খারাপ কিছু হয়েছে। সবার আগে মনে এল সুমন আর ছোটনের কথা। ওরা আমার খালাত বোন ঈষিকার দুই ছেলে। গাঁয়ে থাকে। আমি চটজলদি ফোন করলাম ওদের বাসায়। জানতে চাইলাম, ভাল আছে তো সুমন-ছোটন? গাঁয়ে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। তাই মোবাইলে চার্জ থাকে না। বাসা থেকে কিছু জানাতে পারল না। বোন ঈষিকার ফোন সুইড্ অফ। তাতে সন্দেহ বদ্ধমূল হলো আমার।’