রিয়া এল বেশ খানিকটা দেরি করেই। রাস্তায় হেভি জ্যাম, এ কথা টপ্পাগানের ধুয়োর মত বারবার না বললেও চলে।
কলিংবেল চাপার শব্দে আগন্তুকের অস্থিরতা স্পষ্ট।
দরজা খোলা মাত্র ঝড়ের বেগে ভেতরে ঢুকল রিয়া। অবিন্যস্ত কেশদাম, চোখে-মুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা পরিষ্কার।
‘কফি চলবে?’
‘আপত্তি নেই। না হলেও ক্ষতি নেই। আমি নাশ্তা করেই এসেছি।’ রিনরিনে গলায় বলল মেয়েটা।
রিয়া সুন্দরী, হাল আমলের চুনকাম ছাড়াও।
আমি শুরুতে খানিক চাতুর্যের পরিচয় দিলাম। সেটা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের প্রয়াস। রিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ‘বাসায় স্রেফ আমরা দু’জন। তবে এমন মনে করার কোনও কারণ নেই, তুমি আসবে, তাই বাসা খালি! আমার বয়স হয়েছে, আমাকে তুমি ভরসা করতে পারো। বার্ধক্যের ভীমরতি এখনও চেপে বসেনি।’
রিয়া লজ্জা পেল।
আমি সেটুকু উপভোগ করলাম। যদিও মনে করি না যে লজ্জা কেবল নারীরই ভূষণ। ওটা সবার থাকা উচিত। লজ্জা পাওয়া মানে বিবেকবোধ এখনও পুরোপুরি উবে যায়নি।
রিয়া আমার কথা শুনে ক্লিষ্ট হাসল।
নিজ হাতে ওকে কফি করে দিলাম। সময় দিলাম, যাতে আরেকটু সুস্থির হয়ে বসতে পারে। একটু পর বললাম, ‘নাও, এবার শুরু করো। তোমার জরুরি কথাটা কী, সেটা শুনি। ইনফ্যাক্ট, লেখার পাট চুকিয়ে তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম।’
ওর পরনে জলপাই রঙ সালোয়ার, পায়ে হাওয়াই চপ্পল। তার মানে, একদম ঘরোয়া পোশাকেই চলে এসেছে। বেশ বদলের সময় পায়নি।
শুরুতেই ভয়ানক এক কথা দুম করে বলল রিয়া, ‘বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, তবে আমার কারণে মৃত্যু ঘটেছে আটজন মানুষের। এরা সবাই আমার পরিচিত। দু’একজন নিকটাত্মীয়ও।’
‘মানে? তোমার কারণে মারা গেছে! কীভাবে! তোমার মত মেয়ে কারও ক্ষতির কারণ হতে পারে?’ আমি বিস্মিত।
‘আপনি আমাকে কতটুকু চেনেন, স্যর? আমি একটা অপয়া!’
ব্যস, হয়ে গেল। মাথায় রক্ত উঠে গেল। কুসংস্কার আমার ভারি অপছন্দ। এখনও কেউ পয়া-অপয়ায় বিশ্বাস করে, তা মেনে নিতে আপত্তি আছে। কো-ইনসিডেন্স বা কাকতাল হতে পারে। তাই বলে কেউ কারও জন্য মারা যায়, এ কথা মেনে নেয়া কঠিন।
আমার কৌতূহল মেটাতে কথার ঝাঁপি মেলে ধরল রিয়া। একে একে বলে গেল সবগুলো ঘটনা।
‘১৩ জুন, ২০১০। মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠলাম। আমার চিৎকার শুনে আব্বু-আম্মু, বড় আপু, সবাই ছুটে এল। ওরা জানতে চাইল কী হয়েছে। আমি ঠিক বুঝলাম না। তবে আবছা মনে পড়ল আমি কোথাও বন্দি। বুকে বড্ড চাপ। আব্বু তক্ষুণি ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছেন। আপু বললেন, অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করতে। আমি ওদের বিরত করলাম। তখনও হাপরের মত বুকের ভেতরটা ধড়াস ধড়াস করছে। আমি কুলকুল করে ঘামছি। বেশ বুঝতে পারছি, জ্ঞান হারাচ্ছি। কান্না জুড়ে দেন আম্মু। আব্বু হতভম্ব! আপু চোখেমুখে পানি ছিটাতেই জ্ঞান ফেরে আমার। তারপর একটু একটু করে সিনেমার রিলের মত চোখের পাতে ভেসে উঠল পুরো ঘটনা।’
‘স্বপ্নে কী দেখলে?’ প্রচণ্ড কৌতূহল বোধ করছি আমি।
এখনও পষ্ট মনে আছে, দেখলাম কোনও এক হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছি। চারপাশে ছোটাছুটি করছে ডাক্তার ও নার্স। নার্সের হাতে ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ, গজ-তুলোর উৎকট গন্ধ। ওরা সব এমন কাণ্ড করছে, যেন তক্ষুণি মারা যাচ্ছি আমি।’
‘তারপর?’
‘আমি আসলে মরিনি। পরের দৃশ্য আরও ভয়ঙ্কর। পথ হারিয়ে ফেলেছি। কেউ যেন তাড়া করছে আমাকে। খুঁজে পেলাম না হাসপাতাল থেকে বেরোবার পথ। ছোট্ট করিডোরের মত প্যাসেজ পেরিয়ে যেখানে গেলাম, সেটা একটা মর্গ। অন্ধকার কুঠরিতে সারে সারে শুয়ে আছে লাশ। সব লাশের চেহারা বীভৎস। অথচ যদ্দূর জানি, মুর্দাখানায় লাশেরা সাদা কাপড়ে ঢাকা থাকে, কারও মুখ দেখতে পাবার কথা নয়। দেখলাম, মোট দশখানা খাট মর্গে। একটা ফাঁকা। কে বা কারা যেন জোর করে আমাকে সেখানে শুইয়ে দিতে চাইল।’
‘সত্যি ভয়ঙ্কর! অবিশ্বাস্য!’ অস্ফুটে বললাম আমি। এমন অদ্ভুতুড়ে ঘটনা জীবনে শুনিনি।
‘এখানেই শেষ নয়, আরও আছে, স্যর। শুনবেন?’
‘শুনব, তবে তার আগে তোমাকে ওই ‘স্যর’ শব্দটি ভুলতে হবে। আমি তো তোমাকে ধরে রাখিনি, রিয়া, যে, বারবার ছাড়তে বলছ!’ হাসার চেষ্টা করলাম। আসলে ওর দুঃস্বপ্নের কথা শুনে বিপন্ন বোধ করছি। হাসি-কান্নার মত ভয়ের ব্যাপারটাও বোধ হয় সংক্রামক।
‘ওকে, স্যর, তাই হবে।’
‘আবার স্যর! দেখো, রিয়া, আমাকে তুমি বন্ধু ভাবতে পারো। অসম বয়সে কি বন্ধুত্ব হয় না! বন্ধু ভাবলে মনের কথা খুলে বলাটা আরও সহজ হবে।’
‘ওকে, তাই হবে।’ রিয়া আবার শুরু করে। ‘আমার স্বপ্নে খুন, মৃত্যু, রক্তারক্তি নিয়মিত ব্যাপার। আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না, প্রতিটা রাত যেন শুরু হয় দোজখের কষ্ট নিয়ে। মানুষ ঘুম না পেলে সিডেটিভ বা ট্রাঙ্কুলাইযার খেয়ে ঘুমায়। আর আমি চাই এমন কোনও ওষুধ, যা খেলে জীবনে আর ঘুম আসবে না। আমি ঘুমোতে চাই না। ঘুম আমাকে ক্রমশ খুনির পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে।’
‘বুঝলাম না। তুমি স্বপ্নে কী দেখলে, তাতে দুনিয়ায় কার কী এসে যায়!’
‘এসে যায়, স্যর। আমার প্রতিটা দুঃস্বপ্নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক-একটা মর্মন্তুদ ঘটনা। আমি যে রাতে হাসপাতাল আর মর্গের স্বপ্ন দেখলাম, এর ঠিক পরের দিন রোড অ্যাকসিডেন্ট করে হাসপাতালে ভর্তি হন আমার সবচে’ কাছের বন্ধুর বাবা হাসমত আঙ্কেল। আপনি হয়তো বলবেন, এর সঙ্গে আমার স্বপ্নের কী যোগসূত্র!’