ক্যামেরায় তোলা ছবিতে আসমার ডান চোখের নিচে তিল দেখা যাচ্ছে।
স্কেচে নেই!
দুঃস্বপ্ন – অরুণ কুমার বিশ্বাস
লেখাটা প্রায় শেষ করে এনেছি, আর মাত্র দুটো অধ্যায় বাকি। বিষয় মনস্তত্ত্ব, কাহিনীতে অস্পষ্টভাবে হলেও ‘প্যারানরমাল’ কিছু ব্যাপার আছে। সামনে ঈদ, সময়মত ম্যানুস্ক্রিপ্ট জমা দেবার জন্য প্রকাশক বেশ চাপে রেখেছেন। বয়স হচ্ছে, এখন আর আগের মত এক সিটিঙে দু’চার ফর্মা নামানো যায় না। মন ও মগজ দুটোরই যথেষ্ট অধঃপতন ঘটেছে, ও বস্তু আগের মতো ক্রিয়াশীল নয়। এখন অল্পতেই টায়ার্ড হয়ে পড়ি। সত্যি, বয়স কাউকে ক্ষমা করে না।
সন্ধে উতরেছে। ক্ষণিক অবকাশে কফির সঙ্গে টোস্ট নিয়ে বসেছি। কফির নেশা আমার অনেক দিনের। কফিতে পৌরুষের গন্ধ পাই। তাই ওটা ছাড়তে পারছি না। ডাক্তার অবশ্য বলেছেন, মাত্রা না ছাড়ালে চা বা কফিতে হার্টের তেমন ক্ষতি হয় না।
হঠাৎ সেলফোন বেজে উঠল।
লিখেটিখে সামান্য পরিচিতি হওয়ায় ইদানীং লোকে বেশ জ্বালায়। নতুন লেখকরা তালিম নেবার অজুহাতে যেমন আসে, তেমনি অনেকে আসে স্রেফ গুল ঝাড়তে বা আড্ডা মারতে। ‘প্যারানরমাল’ লেখক হিসেবে আমার বেশ খ্যাতি। তাই কেউ কেউ স্রেফ ‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’ হয়ে ছুটে আসে আমার কাছে। এমনই কারও ফোন এল সন্ধের মুখে।
ফোনের এপারে আমি কি না নিশ্চিত হয়ে ওপার থেকে বলল, ‘স্যর, আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে পারি? খুব জরুরি।’
যে বা যিনি আমাকে স্মরণ করেছেন, তিনি নারী, বয়স সম্ভবত পঁয়ত্রিশের ওধারে নয়, সুন্দর কি অসুন্দর সেটা অবশ্য স্বচক্ষে না দেখে আন্দাজ করা কঠিন। তবে বেশ গুছিয়ে কথা বলে সে। প্যারানরমালের পাশাপাশি গোয়েন্দা ধাঁচের লেখাও লিখি। সেই সুবাদে অজানা বিষয়ে বা ব্যক্তি সম্পর্কে প্রাথমিক অনুমান করার বিদ্যেটা খানিক রপ্ত হয়েছে আমার। নেপথ্যে বলি, ইদানীং লেখকরা খানিক জাতে উঠেছেন। লোকে এঁদেরকে সম্মানসূচক ‘স্যর’ সম্বোধন করে।
‘কেন, বলুন তো?’ কফির মগে আয়েশি ঢঙে ঠোঁট ছুঁইয়ে অম্ল-মধুর স্বরে জানতে চাইলাম।
কেমন ফ্যাসফেঁসে গলায় মেয়েটি বলল, ‘শুনলে বুঝবেন, ব্যাপারটা সত্যি সিরিয়াস। আপনি দয়া করে একটু সময় দিলে হয়তো বেঁচে যাবে একটি লোকের জীবন।’ ওর নাম রিয়া, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগে পড়ছে। রিয়া আরও জানাল, গত ন’ রাত সে ঘুমোতে পারছে না। ভয়ে, কষ্টে, আতঙ্কে।
রিয়ার কথা শুনে মনটা খানিকটা নরম হলো আমার।
আসুক না, কথাটথা বলে ওর মন যদি খানিক নির্ভার হয়, তো ক্ষতি কী!
তা ছাড়া, রিয়া আরও বলল, সে নাকি আমার লেখার খুব ভক্ত। রহস্যপত্রিকায় নিয়মিত আমার মনস্তত্ত্ব বিষয়ক উপন্যাসিকা পড়ে। শুনে বেশ ভাল লাগল। পাঠ্যসূচির বাইরে সাহিত্যটাহিত্য পড়ার অভ্যেস তো এখন বলতে গেলে উঠেই গেছে।
‘কখন আসতে চাও? আমি কিন্তু বিশেষ রাত জাগতে পারি না,’ প্রশ্রয়ের সুরে বললাম।
রিয়া বলল, এক্ষুণি রওনা দিচ্ছে সে সাভার থেকে। আসতে যতক্ষণ লাগে। আমি হিসেব করে দেখলাম, রাত ন’টা, সাড়ে ন’টার কম বাজবে না। বললাম, ‘কাল এলে হয় না! আজ একটু ব্যস্ত। লেখাটা শেষ হয়নি। তা ছাড়া, একটা মেয়ের পক্ষে এত রাতে আসাটা নিরাপদ নয়।’
আমার কথা শুনে কষ্ট পেল রিয়া। আবেগমথিত সুরে বলল, ‘লেখক হয়ে আপনি জেণ্ডার ডিসক্রিমিনেশনে বিশ্বাস করেন! আমি কিন্তু আপনাকে আরও অনেক উচ্চতায় দেখি।’
বোকা মেয়ে! আকাশের দিকে মুখ করে চলে! ওদের কী দোষ, বয়সটাই এমন! মনে মনে হাসি পেল। মুখে বললাম, ‘আমি কী ভাবলাম তাতে কিচ্ছু এসে যায় না, রিয়া। তুমি নিশ্চয়ই আমাকে ডিসেন্ট করবে না, আমরা বড় বড় সব সার্টিফিকেট অর্জন করলেও আদতে শিক্ষিত হচ্ছি না। মেয়েদেরকে আমরা এখনও প্রাপ্য সম্মান দিতে শিখিনি। আমাদের দেশে ওরা এখনও পণ্য। স্রেফ বিজ্ঞাপন সামগ্রী বা ওপরে ওঠার মই।’
রিয়া জেদি গলায় বলল, ‘আমি আসছি। এক্ষুণি। ঠিকানাটা একটু বলুন, প্লিজ। ঢুকতে দিলে দেবেন, নইলে ফিরে যাব। মাঝরাত হলেও আটকাবে না।’
এরপর আর কথা চলে না। আফটার অল, শি’য মাই ভ্যালুড রিডার! একজন লেখকের কাছে এর মূল্য অপরিসীম।
পরে ভীষণ আপসোস হলো। বোকামোর জন্য নিজেই নিজেকে ভর্ৎসনা করলাম। এতক্ষণে খেয়াল হলো, বাসায় আমি একা। স্ত্রী গেছে সন্তানদের নিয়ে মামাবাসায় গিয়ে দুধ-দই সাঁটাতে। ছুটা বুয়া রান্না শেষ করে চলে গেছে অনেকক্ষণ। এমন নাজুক পরিস্থিতিতে এক যুবতী মেয়েকে বাসায় ডাকার পেছনে আর যাই হোক, যুক্তিগ্রাহ্য কোনও কারণ থাকতে পারে না। তা ছাড়া, সময়টা যখন রাত।
আমি ধন্ধে আছি। কারও মনের ভার লাঘব করতে গিয়ে নিজের ঘর আবার না ভাঙে! মনে বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। বলতে নেই, এরপর আর লেখা চলে না। কারণ লেখালেখিটা করপোরেশনের পানির নল নয়, শুধু পড়তেই থাকবে। ইদানীং অবশ্য কেউ কেউ ফরমায়েশি লেখা লেখেন, যার আগামাথা কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই। অর্ডারি মাল কি না! মুফতে জাস্ট দুটো পয়সা পাওয়া যায়। অথচ লেখকদের লোভী হলে চলে না।
আমি অপেক্ষমাণ। রিয়া আসবে। বুকে চিনচিনে অপরাধবোধ প্রমাণ করে আমি লোকটা তত স্বচ্ছ নই। মনে গ্লানিবোধ আছে। পাপবোধও।