‘শোন, আসমা! তুই বহুত মানুষরে মারছস! তুই আমার পোলার খুনি! আমি তোর এই চাচা-চাচীরে খতম কইরা দিমু!’
লোকটার কথাগুলোকে পাত্তা দিল না পুলিশ। ওসি ইশারা করতেই কয়েকজন কনস্টেবল বকুলের বাবাকে নিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে দিল।
আপাতত বাড়ি যাওয়ার অনুমতি পেল তুষার আর মিলন। রাতেই থানায় খবর দিয়েছিল তারা। এ কারণে পুলিশের সুনজরে আছে দু’জন। তবে থানা আর আদালতে ডাক পড়তে পারে, এমনটাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
যাওয়ার সময় আসমার সঙ্গে দেখা করতে চাইল তুষার। মিলনের বাধা ডিঙিয়ে সোজা চলে গেল ঘটনাস্থলে। রক্তের দাগ তখনও শুকায়নি। স্কেচ খাতা বুকে জড়িয়ে একপাশে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আসমা। তুষারকে দেখে মুখ তুলে তাকাল। এরপর তাকে অবাক করে স্কেচ খাতা বাড়িয়ে ধরে বলল, ‘আফনে এটা লইয়া যান। আফনেরে দিলাম এটা। ছাপাইয়া দিয়েন পত্রিকায়।’
আসমার কথাগুলো বুকের মধ্যে খচ করে বিধলেও স্বাভাবিক থাকল তুষার। ‘আচ্ছা, আপাতত নিয়ে গেলাম। পরে আবার ফেরত দেব তোমাকে।’
মিলন হ্যাঁচকা টানে তুষারকে নিয়ে রীতিমত হনহন করে হাঁটা দিল।
রইসুও স্ত্রীকে ইশারা করল।
পুলিশের কাজ শেষ হলেই তারা চলে যাবে কোনও এক আত্মীয়ের বাড়ি।
.
বিকেল।
জমেছে বেশ কুয়াশা।
আসমার স্কেচ খাতার একটা করে পাতা ওল্টাচ্ছে তুষার, আর হড়বড় করে বর্ণনা করছে মিলন।
‘আসমার সঙ্গে পড়ত। অনেক আগের ঘটনা। মাইয়াটা পানিতে ডুইবা মরসে।’
তুষার পাতা ওল্টাচ্ছে। কোনওটা সামনা-সামনি আঁকা পোর্ট্রেট। কোনওটা আবার গ্রামের পরিবেশে।
‘এটা খুড়ুম মিয়া। আসল নাম জানি না। লোকটাও বদের হাড্ডি। ডাকাত দলে যোগ দিসিল। মরসে ডাকাতি করতে গিয়া। আর এইটা নিতুনের মা। ওর একটা রোগ হইসিল। সারা গায়ে পচন ধরছিল। আমি শুনছিলাম ও-ই নাকি আসমার কাছে গিয়া বলছিল, তার যেন একটা ছবি আঁইকা দেয়।’
‘উনি মারা গেলেন কী করে? পচন ধরেই?’
‘আরে, নাহ্। ছবি আঁকছে কি সাধে! মহিলা রাস্তা পার হইতেছিল, সোজা বাসের চাকার তলে। এক সেকেণ্ডে শেষ।’
‘হুম। ব্যতিক্রম তা হলে আমি। হা-হা-হা। ভাল কথা, সবাই কি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই মারা গেছে? নাকি আমার হাতে এখনও মরার মত সময় আছে?’
মিলনের কঠিন চেহারা দেখে হাসি থামাল তুষার।
‘আমি আরেকটা পরীক্ষা নিতে চাই। ব্যবস্থা করে দে।’
‘কোনও কাম নাই। বহুত বড় বিপদ থেকে বাঁচছি। এখন তুই ভালয় ভালয় ঢাকা যা।’
‘উঁহুঁ। এর একটা বিহিত করতে হবে।’
‘কীসের বিহিত করবি! তুই বাঁইচা গেছস, এটাই বড় কথা। এখন এসব বাদ দে।’
‘ওর খাতাটা ফেরত দেব। এত সুন্দর সব পোর্ট্রেট। আমি এমনি এমনি নিয়ে যেতে পারি না।’
‘ফেরত দিয়া দে। আমারও তাই মনে হয়। এসব অলক্ষুণে জিনিসপত্র….
‘একমিনিট!’
তুষারের গলায় ভয় আর বিভ্রান্তির মিশেল।
উবু হয়ে দেখল মিলন। ঘাবড়ে গেল ভীষণ।
শেষ পৃষ্ঠায় নিজের একটা ছবি এঁকেছে আসমা!
আট
আসমাদের বাড়ির সামনে ভিড়। কনকনে ঠাণ্ডার মধ্যেও গ্রামবাসীর ভিড়। সবাই কেমন যেন ভয়ে ভয়ে আছে। রইসুকে দেখা গেল না। এক কোনায় আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে দেখা গেল আসমার চাচীকে। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল মিলন। জানল, আসমাকে পাওয়া যাচ্ছে না। কাউকে না বলে বের হয়ে গেছে। গতরাতের ঘটনার পর গ্রামবাসীদের যারা বিশ্বাস করেনি এতদিন, তারাও বলাবলি করছে, ‘এইবার না জানি কার ছবি আঁইকা ফালায়, গো! আল্লাহ গো, কী পিশাচিনীর কবলে পড়ল নিশিন্দাপুর!
তুষারের মাথা কাজ করছে না। স্কেচ খাতাটা নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছে না। এটা দেখলেই একটা হই-চই কাণ্ড ঘটবে।
হুট করে খাতাটা কেড়ে নিল মিলন। তারপর এগিয়ে গেল আসমার চাচীর দিকে।
‘এই যে দেহেন, ভাবী।’
গ্রামবাসীও দেখল। রব উঠল, আসমা তা হলে মরে গেছে!
এবার আফসোসের কমতি নেই কারও গলায়।
‘আহারে! ফালাইল।’
মাইয়াটা। শেষতক নিজেরেই মাইরা
এমনসময় ছুটে এল রইসু। পায়ে কাদার ছোপ। নদীর দিকে গিয়েছিল সম্ভবত। শীতেও গায়ে চাদর নেই। এসেই চিৎকার জুড়ে দিল। ‘চান্দুয়ে দেখসে ওরে। নদীর ধারে যাইতে! মাইয়া আমার নদীতে ডুইবে গেল না তো!’
সবার সঙ্গে ছুট লাগাল তুষার ও মিলন। চান্দু নামের লোকটা নদীর যে প্রান্তে আসমাকে দেখেছে, সেখানেই শেল সবাই। কিন্তু খোঁজার সুযোগ নেই। দু’পাশে ধু-ধু চর। আর একদিকে পানি। অন্ধকারে পানিতে লাশ থাকলেও তা দেখার উপায় নেই। টর্চের আলোয় তুষারই খুঁজে পেল পায়ের ছাপ। গুটি গুটি গেছে পানির দিকে। বুক কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল তুষারের। একসময় ইস্তফা দিল খোঁজাখুঁজিতে। দুই বন্ধু ফিরে এল নিজেদের ঘরে।
নয়
ঢাকার ফ্ল্যাটে নিজের রুমে বসে আসমার স্কেচবুকটা বুকে রেখে চোখ বুজে আছে তুষার। গল্পটা লিখবে কি লিখবে না, ভাবছে।
শুরুটা করবে কী করে?
মেয়েটার মায়াবি দু’চোখ আর কোঁকড়া চুল দিয়ে?
ভাবতেই হুট করে কী যেন ধরা পড়ল মনের রেইডারে। কোথায় যেন একটা খটকা। সেই পুরনো খচ-খচে অনুভূতি। ড্রয়ার থেকে নিজের স্কেচটা বের করল তুষার। ভাল করে খুঁটিয়ে দেখল ওর পোর্ট্রেটটাকে। ডান চোখের নিচে কালো একটা তিল। বাম কানের লতিও নেই আসমার আঁকা ছবিতে। আয়নায় দেখল নিজেকে। কানের লতি ঠিকই আছে। ডান চোখের নিচে কোনও তিলও নেই তার। এবার দ্রুত আসমার স্কেচবুকটার শেষ পাতা ওল্টাল। নিজের ক্যামেরায় তোলা আসমার ছবিটা জুম করল কম্পিউটারের মনিটরে। খুঁটিয়ে দেখল স্কেচ আর ক্যামেরায় তোলা ছবি। ধীরে-ধীরে হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলের মাঝে এক রহস্য ঘেরা আনন্দের অনুভূতিতে ছেয়ে গেল তুষারের মন।