ভয় প্রথমে কাবু করে। পরে মগজ তার নিজের মত করে বানিয়ে নেয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। দুই বন্ধুর মগজেই চালু হয়ে গেছে ডিফেন্স মেকানিজম।
ঘুমিয়ে থাকা আসমার দিকে এগিয়ে আসছে রামদা ধরা লোকটা।
স্ট্যাচু হয়ে আছে তুষার আর মিলন। সামান্য ভুলচুক হলে নিজেদেরও কোপ খাওয়ার আশঙ্কা। এদিকে কোনও শব্দ না হলেও নড়েচড়ে উঠল আসমা।
ঘুমের ঘোরে বিপদও টের পায় না তো মেয়েটা?
শুকিয়ে গেছে মিলনের মুখ। একটা কিছুর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তুষার তাকিয়ে আছে আসমার পায়ের কাছে থাকা লেপটার দিকে।
দ্রুতই ঘটে গেল ঘটনাগুলো। লোকটা রামদা উঁচু করেছে কোপ দেয়ার জন্য। এমনসময় চোখ মেলে তাকাল আসমা। চিৎকার দিল না মেয়েটা।
তুষার এক ঝটকায় লেপটা তুলে ঝাঁপ দিল রামদা ধরা লোকটার ওপর। লেপ থাকায় ধারাল দা নিয়ে ভাবতে হলো না তাকে। তবে আলগোছে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ভ্যাবাচেকা খাওয়া লোকটা। পরের কাজটা করল মিলন। লাইটটা অন করে দিয়েই পেছন থেকে গলা আঁকড়ে ধরল লোকটার। আসমা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। তুষার নিজেকে সামলে নিয়ে লোকটার মুখে আনাড়ি হাতে ঘুষি বসাল। বিশেষ সুবিধা হয়নি। তাগড়া লোকটা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে দুদ্দাড় করে। একপর্যায়ে হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে দিল মিলনকে। আসমা ততক্ষণে উঠে চৌকির অন্যপাশে চলে গেছে। মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিল একটা স্কুলব্যাগ। তুষার ক্ষণিকের জন্য আসমার দিকে তাকাতেই অঘটনটা ঘটল। তুষারের কপালের ডানপাশে দড়াম করে ঘুষি বাগাল লোকটা। মাথা দুলে উঠল তুষারের। কাজ করছে না মাথা। কপালে হাত রেখে চৌকিতে বসে পড়ল ও। লোকটা এদিক-ওদিক তাকিয়ে রামদাটা খুঁজছে। মিলন তার সর্বশক্তি দিয়ে আবারও পেছন থেকে ঝাপটে ধরল। তুষার চিৎকার দিয়ে রইসুর ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করল। কিন্তু গলা দিয়ে বেরোচ্ছে না শব্দ। আর ঘুম ভাঙলেও লাভ নেই। বাইরে থেকে সে নিজেই ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছে। আসমার ওপর রাগ হলো খুব। সে-ও শব্দ করছে না। এরকম ভয়াবহ সময়ে হাতে খাতা আর পেনসিল নিয়ে করছেটা কী মেয়েটা!
’তুষার, ওঠ! শালারে মার!’
‘রইসুকে ডাক দে!’
‘আগে শালারে সাইজ কর্। পরে! নইলে পুলিশি ঝামেলা!’
আততায়ীকে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারবে না মিলন। তুষার উঠে গিয়ে আরেকটা ঘুষি পাকানোর চেষ্টা করল। তবে পারল না।
কানে আসছে আসমার পেনসিলের খসখস শব্দটা। হঠাৎ পুরো শরীর দুলে উঠল তার। বসে পড়ল মেঝেতে। শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি যেন। লোকটার মুখে ক্রূর হাসি। মিলন তার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। রামদাটা দেখতে পেয়েছে ওরা দু’জন। টেবিলের পায়ার সঙ্গে লেগে আছে। ছাড়া পেলে নিশ্চিত কাউকে আস্ত রাখবে না আততায়ী। পেরে উঠল না মিলন। এক ঝটকায় তাকে ছুঁড়ে ফেলল লোকটা। চোখের কোনায় তুষার সব দেখছে। সামনে এগোতে যাবে, অমনি মেঝেতে পিছলে দড়াম করে পড়ল লোকটা। থরথর করে কিছুক্ষণ কাঁপল বিশাল দেহটা। এরপর কোনও নড়চড় নেই। কসরত করে ফের উঠে দাঁড়াল দুই বন্ধু। নিচে ভেজা ভেজা কী যেন। রক্ত!
রামদাটার চোখা মাথা লোকটার চোখ এ-ফোঁড় ও- ফোঁড় করে ঢুকে গেছে!
চৌকির ওপাশে ভয়ার্ত চোখে চেয়ে থাকা আসমা। ওর হাতের কাগজে চোখ পড়ল দু’জনের। আততায়ীর পোর্ট্রেট!
সাত
অনেকগুলো ফোনকল, বানানো গল্প আর শেষমেশ আসমার জবানবন্দি; এসবের কারণে এ যাত্রা বেঁচেই গেল তুষার ও মিলন। তাদের গল্পটাও বিশ্বাসযোগ্য। রইসুর কাছেই এসেছিল আসমার গল্প শুনতে। এসে দেখে দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকে দেখে রামদা হাতে এক লোক আসমাকে মারতে যাচ্ছে। কিন্তু নিজেই চিৎপটাং হয়ে পড়ে যায় রামদার ওপর। ওরাই গিয়ে পরে রইসুর দরজা খুলে দেয় আর পুলিশকে খবর দেয়। এদিকে নিহত লোকটা ছিল তিন-চারটা খুনের মামলার পলাতক আসামী। পুলিশের খাতায় দুইয়ে-দুইয়ে চার। তবে ছাড় দেয়ার পাত্র নয় বকুলের বাবা। ক্ষমতার পুরো দাপট কাজে লাগানোর চেষ্টায় আছে। যথারীতি ঘটনাস্থলে এসেছে মাংকি টুপি পরে। তুষার আর মিলনকেও একহাত দেখে নেয়ার কথা বলেছে এক ফাঁকে।
আসলে ঝামেলা পাকিয়ে দিয়েছে আসমার আঁকা ছবিটা। এত কিছুর মধ্যে আততায়ীর পোর্ট্রেট আঁকল কখন? রইসুর উত্তর, ‘ছবি মরার পরেই এঁকেছে ও। চোখের সামনে যাকে দেখে, তাকে আঁকে। মাইয়াডার একটু মাথায় সমস্যা আছে, স্যর।’
পুলিশের ওসি আমুদে লোক। কুখ্যাত আসামীকে এভাবে ঘায়েল হতে দেখে ভেতরে ভেতরে তিনিও খুশি। আসমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তা, মামণি, আমার একখান ছবি আঁইকা দাও তো দেখি।’
তুষারের একবার ইচ্ছা হলো বলে, না থাক দরকার নেই। কিন্তু চুপ মেরে রইল। আততায়ীর মৃত্যুটা দুর্ঘটনাই। বাধা দিল বকুলের বাবাও। ‘খবরদার, আঁকবি না। আঁকলে তোরে…না মানে… ওসি সাব, ও যার ছবি আঁকে, সে মারা যায়। আপনে ভুলেও আঁকাইয়েন না। আর নাটের গুরু হইল ওই রইসু। সে এই মাইয়াডারে ব্যবহার করে। সে এই মাইয়ারে দিয়া অনেকরে মারসে। সে একটা খুনি।’
‘তাই নাকি! হো-হো-হো! আচ্ছা, আচ্ছা। কিন্তু গতরাতের খুনের চেষ্টার মোটিভ তো পাচ্ছি না। তা, চৌধুরী সাহেব, আপনার ছেলে না ক’দিন আগে মারা গেল? আপনি এখানে কেন? আপনার তো বাড়িতে থাকার কথা। যান, যান, রেস্ট নেন।’