রইসুও কম যায় না, ‘আপনে কিন্তু বাড়াবাড়ি করতাসেন। আমি মামলা করুম কইলাম! পোলা মরসে দেইখা কিছু কইলাম না। কিন্তু গেরামের দশজনরে জিগান, আপনের পোলা কেমুন আছিল। সে যাউকগা। অ্যাক্সিডেন্টে মরসে, এটা সবাই জানে। ক্যান শুধু শুধু আমার মাইয়ারে দোষ দেন!’
ও তোর মাইয়া কেডা কইসে! তুই ওর পাতাইন্না চাচা। ওই মাইয়া তার বাপরে মারসে! এখন তুই কালসাপ পুষতেছিস! খবরদার! আমি ওরে দেইখা লমু!’
এরপর হুট করে ঘটল কতগুলো ঘটনা। বাড়ির ভেতর থেকে সামনের রাস্তায় হুড়মুড় করে বের হলো আসমা। হাতে পেনসিল আর কাগজ। তাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে হম্বিতম্বি করতে থাকা লোকগুলো আচমকা পিছিয়ে গেল। ভয় জিনিসটা দারুণ ছোঁয়াচে। সঙ্গে সঙ্গে ভিড় জমানো লোকগুলোও চলে গেল। বকুলের বাবা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা কাপড় দিয়ে মুখ-চোখ ঢাকতে ব্যস্ত। পড়ে গেছে কারও কারও হাতের লাঠি। শাসাতে শাসাতে একপর্যায়ে চলে গেল প্রত্যেকে। আসমাও হনহন করে আবার ঢুকে পড়ল ঘরে। সবাই চলে যাওয়ায় এগিয়ে গেল তুষার। অনিচ্ছাসত্ত্বেও পিছু নিল মিলন।
‘রইসু ভাই। একটু আসমার সঙ্গে কথা বলব।’
‘না, কোনও কথা নাই। আপনে যান! বাইর হন!’
মিলন ইশারায় কী যেন বোঝাতে চাইল রইসুকে। সাংবাদিক শব্দটা শুনে ঘাবড়ে গেল।
‘দেখেন, মেয়েটা বহুত পেরেশানিতে আছে,’ বলল রইসু।
‘হুম। কিন্তু মোবাইলে ছবি তোলার বিষয়টা তো সত্য। পেরেশানি তো আপনিই তৈরি করেছেন!’ এবার উল্টো রইসুকে শাসাল তুষার।
মুহূর্তে মিইয়ে গেল লোকটা। মিনমিন করে কী যেন বলতে চাইল। কিন্তু অনেকটা জোর করেই ঘরে ঢুকে গেল তুষার। পিছু নিল মিলন। সোজা চলে গেল আসমার ঘরে। রাগ নয়, মেয়েটার চোখে কেমন যেন হতাশার ছাপ।
‘আসমা, শোনো।’
‘আমি জানি আপনি কী কইবেন।’
‘কী বলব?’
‘আমি ঠিক আছি। পিশাচিনী না। তয় আমি কারও ছবি আঁকতে চাই না।’
‘তুমি অবশ্যই আঁকবে। সবার ছবি আঁকবে।’
‘আমি কাউরে মারতে চাই না। চাচায় আমারে বলসে লোকটা বদ। চাচী আর আমারে মাইরা ফেলবে কইসে। এইজন্য আঁকসিলাম।’
‘আমি সেটা বলিনি। তুমি আঁকলে মানুষ মারা যাবে, এটা ডাহা মিথ্যে কথা। তুমি এসব বিশ্বাস করবে না। তুমি চমৎকার ছবি আঁকো। তোমার উচিত বেশি বেশি আঁকা।’
আসমাকে এবার আহত দেখাল। মনে হচ্ছে যেন তুষারের কথা সত্য হলেই সে খুশি হত।
তুষার বলল, ‘তা হলে আমাকে বলো, তুমি আমার ছবি এঁকেছ, আমি মারা যাচ্ছি না কেন? আমাকে তুমি পছন্দ করো, তাই?’
আসমা নীরব।
‘আচ্ছা, তোমার চাচা কি তোমাকে মাঝে মাঝেই ছবি আঁকায় নাকি?’ প্রশ্নটা নিজের কানে বেখাপ্পা শোনালেও না জিজ্ঞেস করে পারল না তুষার।
পেছনে ততক্ষণে রইসু এসে দাঁড়িয়েছে।
‘ভাইজান, আপনেরা যান। বহুত পেরেশানিতে আছি। আর না। আমরা ভিটা ছাইড়া ভাগব।’
‘কেন! আপনার হাতে তো ব্যাপক ক্ষমতা। কেউ কিছু বললে তার ছবি আঁকিয়ে নেবেন আসমাকে দিয়ে, হা-হা-হা! পালাবেন কেন?’
মিলন অনেকটা জোর করেই তুষারকে টেনে বের করল আসমার রুম থেকে। এরপর একটা ভ্যানে করে দু’জনে চলে এল বাড়িতে।
শীতের রাত। কুয়াশাও বেশ। এর মধ্যে কোথা থেকে যেন খই জোগাড় করেছে মিলন। গুড় দিয়ে ওটা চিবিয়ে চলেছে দু’জনে। তুষারের পোর্ট্রেট আঁকার চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। মিলনকে বেশ নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে। বলা যায় নিজের আগের রূপে ফিরে গেছে ও।
‘চল, দোস্ত, খেজুরের রস চুরি করি। এই অ্যাডভেঞ্চার তুই আর কখনও পাবি না।’
‘হুম। চুরি করব ভাবছি। তবে রস নয়। আরেকটা জিনিস।’
মিলন সতর্ক।
‘আসমার টেবিলের নিচে রাখা একটা বাক্সে একটা স্কেচ খাতা দেখেছি। আমরা যাব ওটা চুরি করতে।’
ছয়
শীতের রাতে গ্রামে আটটা বাজতেই লেপমুড়ি দেয় সবাই। তবে রিস্ক নিল না দুই বন্ধু। দশটা বাজতেই রাতের গ্রাম দেখার নাম করে চাদর মুড়ি দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। উত্তেজনার কারণে গায়ে লাগছে না হাড়কাঁপানো শীত। রইসুর বাড়িতে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সবাই ঘুমিয়ে। মিলনের চালচলনে জেমস বণ্ডের ভাব। চিকন তার দিয়ে দরজার খিল খুলতে গিয়ে দু’বার শব্দও করেছে। তবে তাতে ভাঙেনি কারও ঘুম। ধরা পড়লে কী করবে, সেটাও ঠিক করে আসেনি তুষার। একটাই ভরসা: রইসুর টাকা-পয়সা বিশেষ নেই। তাই তুষার আর মিলনকে ছিঁচকে চোরও দাবি করতে পারবে না। এতসব আপাতত ভাবছে না দু’জন। খিল খুলতেই আলতো করে দরজায় ধাক্কা দিল। নিজেরা সেঁধিয়ে গিয়ে টেনে দিল দরজা। খিল লাগাল না। পাছে আবার যদি জলদি পালাতে হয়।
পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমেই বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল রইসুর ঘরের। আসমা সামনের দিকে একটা ঘরে চৌকিতে একা ঘুমায়। রইসুর নাক ডাকার হালকা শব্দ পাচ্ছে ওরা। সেলফোনের টর্চের আলো ফেলল আসমার পড়ার টেবিলের নিচে। স্কেচের খাতাটা দেখতে পেল না। মিলন দাঁড়িয়ে আছে অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে। কেউ জেগে গেলে যেন তাকে ধাক্কা দিয়ে পালানো যায়। কিন্তু আপাতত সেই আশঙ্কা নেই মনে হচ্ছে।
তুষার খুঁজেই চলেছে।
মিলন তাকিয়ে আছে সদর দরজার দিকে। খসখস শব্দ শুনে কান খাড়া। তুষারের খেয়াল নেই। মিলন ইশারা করল। পাত্তা দিল না তুষার। ক্যাচ-ক্যাঁচ করে খুলে গেল সদর দরজা। সাহস উবে গেল মিলনের। তুষারকে ইশারা করায় সে-ও চুপ। টর্চ নিভিয়ে দু’জন আসমার চৌকি ঘেঁষা দেয়ালে একেবারে সিঁটিয়ে রইল। কেউ একজন ঢুকেছে। এবং সে-ও যে চুরি করতেই ঢুকেছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু রইসুর ঘরে চুরি! মুহূর্তে মাথা খেলে গেল তুষারের। বুঝে ফেলল ঘটনা। মুখে কাপড় পেঁচানো লোকটা সতর্ক চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। চাঁদের আলোর প্রতিফলনে হাতের রামদাটা ক্ষণিকের জন্য চকচক করে উঠল।