হাসি খেলে গেল তুষারের চোখে। ‘তুই আমার অভিনয়টাকে সত্যি ভেবেছিলি! হা-হাহ্-হা! আর ছবি আঁকলে যদি মারাই যাব, তো হাসপাতাল আমাকে বাঁচাতে পারবে?’
‘শোনেন! এদিকে আসেন!’
ধমকের সুরে কথাটা বলল আসমা। তার সঙ্গে মাথায় আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে আছে রইসুর স্ত্রী।
‘আসমা, আমি সরি! মানে দুঃখিত। তুমি কষ্ট পেয়েছ। তবে আমি যে বেঁচে আছি, এটা মনে হয় ভালই হলো, নাকি!’
তুষারের কণ্ঠে কৌতুকের ছাপ ধরতে পেরেছে কি না বোঝা গেল না। তবে আসমা তার সামনে আরেকটা কাগজ বাড়িয়ে ধরল। ছবিটা দেখল তুষার ও মিলন। চেনা চেনা মনে হলো।
চলে গেল আসমা ও তার চাচী।
সুনসান নীরবতা।
একে অন্যের দিকে তাকাল তুষার আর মিলন। চিনতে পেরেছে ওরা ছবির মানুষটাকে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া বকুল!
চার
‘ছবিটা পুড়িয়ে ফেলা দরকার।’ মিলনের গলা কাঁপছে।
‘অবশ্যই না। সুন্দর পোর্ট্রেট।’ নির্বিকার তুষার।
‘তুই এখনও বিশ্বাস করছিস না?’
‘কাকতাল বলে একটা ব্যাপার আছে। না হয় অ্যাক্সিডেন্টের পরেই এঁকেছে ও। অবশ্য, এটার কথা জানানো ঠিক হবে না কাউকে। মেয়েটা বিপদে পড়বে। গ্রামের মানুষ তো।’
‘গ্রামের মানুষ তো কী? আমিও তো গ্রামের মানুষ। তো?’
‘না কিছু না। তুই একটু বাড়াবাড়ি করছিস, মিলন। ছেলেটা ওই ছাগলের মত ছটফট করে মরেনি। মদ খেয়ে নিশ্চয়ই বাইক চালাচ্ছিল।’
‘কিন্তু আসমা সেটা আগেই জানে, এবং সে ছবিও এঁকে ফেলেছে।’
‘হুম। সেটাই কাকতাল। কে জানে, হয়তো গ্রামের সবার পোর্ট্রেট সে আগেই এঁকে রেখেছে। যখন মারা যাবে, তারটা বের করে দেখাবে।’ তুষারের কঠিন যুক্তি।
পাল্টা জবাব দিতে পারল না মিলন। তুষারের লেখক মগজের যুক্তি মেনে নিয়ে আপাতত চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নিল। তবে বারবার বন্ধুকে পরখ করে নিতে ভুল করছে না। সেটা দেখে বিরক্ত হলেও কিছু বলল না তুষার। তার আচমকা মরে যাওয়া নিয়ে মিলন যে টেনশনে আছে, এটা ভাবতে বরং ভালই লাগছে তার।
বাড়ির পথ ধরল দু’জন। ছবিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তুষার। গ্রামের সবার পোর্ট্রেট আগেই করে রেখেছে মেয়েটা, নিজের কানেই কথাটা অবিশ্বাস্য লেগেছে তার। ছবিটা দেখেই মনে হয় সামনাসামনি নয়, কোনও একটা ছবি দেখেই এটা এঁকেছে আসমা।
অর্ধেকটা পথ এগিয়েছে সবে, এমন সময় দুই বন্ধুর পথ আগলে দাঁড়াল রইসু।
‘ভাইজানেরা, একটু দাঁড়ান।’
খানিকটা ভড়কে গেলেও সামলে নিল দু’জন।
‘আসমা মাইয়াডা একটু অইন্যরকম। একটু আলাভোলা। লোকে নানান কথাবার্তা কয়। আমগো শত্রুও অনেক। অনেকেই ডরায়। তয়, বাবাজি, আপনে শহর থেইকা আসছেন। মিলনের বন্ধু। আপনের কাছে অনুরোধ, আপনে এইডা নিয়া কিসু লিখতে যাইয়েন না।’
‘না-না, প্রশ্নই আসে না! গুজবে ঘি ঢালব কোন্ দুঃখে?’
কথাটা শুনে কেমন যেন আহত দেখাল রইসুকে।
‘তয়, বাবাজি, ছবিটা আমারে দিয়া দেন। আসমা যেটা দিসে।’
‘এই নিন।’
আবারও সেই খচ-খচে অনুভূতি। তুষার স্পষ্ট বুঝতে পারল, ছবিটা নিতেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছিল রইসু। তার সঙ্গে নিহত ওই যুবকের কোনও সম্পর্ক নেই তো?
বাসায় ফিরেই আবার বেরিয়ে গেল মিলন। তার চলাফেরা এখন অনেকটা দুদে গোয়েন্দাদের মত। তুষারকে একটা কিছু বিশ্বাস করিয়ে ছাড়া পর্যন্ত থামবে না ও। গ্রামের মানুষের কাছ থেকে কথা বের করতে সময় লাগল না তার। রাতের মধ্যেই জেনে নিল ঘটনা। নিহত যুবকের নাম বকুল। বেশ ক’দিন ধরেই নাকি রইসুর স্ত্রীকে বিরক্ত করে আসছিল সে।
পাঁচ
হাই তুলতে গিয়ে মাঝপথে আটকে গেল তুষার। বিছানার পাশে বড় বড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে মিলন। বন্ধুকে হাই তুলতে দেখে হাঁফ ছাড়ল।
‘সারারাত ঘুমাসনি?’ ভ্রূ কুঁচকে জানতে চাইল তুষার।
‘না, অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে বসে ছিলাম,’ খুশি হলেও বিরক্তির ভান করল মিলন।
‘তুই কি হতাশ? আমি মরিনি দেখে?’
মিলন কিছু বলল না। নাস্তার টেবিলেও কথা হলো না খুব একটা। ঘুরতে বের হলো দু’জন। কথাবার্তা বিশেষ হচ্ছে না। তুষারের মনে হলো আসমাকে দিয়ে নিজের ছবি আঁকানোটাই ভুল হয়েছে।
‘চব্বিশ ঘণ্টা এখনও পার হয় নাই,’ বিড়বিড় করে বলল মিলন। একটা শাখা নদীর কাছে চলে এসেছে। তুষার কিছু বলতে যাবে, এমন সময় হই-চই কানে এল। আসমাদের বাড়ির দিক থেকে। ছুট লাগাল দু’জন।
তুষারের আশঙ্কাই সত্যি হলো। রইসুর বাড়ির সামনের রাস্তা ও পাশের খালি জমিতে গ্রামবাসীর ভিড়। মুখে কাপড় পেঁচানো লাঠি হাতে একদল লোকও আছে। ঘটনা পরিষ্কার হলো মুখে কাপড় পরা একজনের কথায়।
‘ওই পিশাচিনীরে আমি মাইরা ফালামু। তুই আমারে চিনস নাই। ঘরে দুধকলা দিয়া তুই পিশাচ পালতেছিস, রইসু! সাবধান! এই গেরামের কাউরে সে বাঁচতে দিব না। তুই মাইয়াডারে বাইর, কর, আইজকাই শেষ কইরা দিমু! আমার পোলারে মারছস তুই! আমার পোলারে!’
‘বকুলের বাপ! খবর ফাঁস হয়ে গেছে রে।’ ফিসফিস করে বলল মিলন।
‘ওরা মুখোশ পরে আছে কেন?’ জানতে চাইল তুষার। ‘বুঝলি না! ওদের ছবি যদি আবার আসমা এঁকে ফেলে!’
‘উফ্। কী থেকে কী! পুলিশ ডাক দে। মেয়েটার তো ভালই বিপদ!’
এদিকে নিহত যুবক বকুলের বাবা চেঁচিয়েই যাচ্ছে। ‘তোকে মোবাইল হাতে ঘুর-ঘুর করতে দেখসে আমার লোক। তুই আমার পোলার ছবি তুলছস। তোর ঘর তল্লাশি করুম আমরা।’