মিলনের অবলীলায় মিথ্যে বলার ক্ষমতা দেখে অবাক হলো না তুষার। এসব না বললে সম্ভবত দেখাই হবে না।
‘আপনারা পরে আসেন। আসমার শরীর ভাল না।’
‘আমরা হাজিপাড়া থেকে আসছি। দুই মাইলের হাঁটাপথ। এখন কেমনে কী করি?’
কিছুক্ষণ নীরবতা। এরপর উঠোনে দুটো চেয়ার পেতে দিল ওই নারী।
‘রইসু ভাই আমার পরিচিত। আপনার লগে আমার খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ হয় নাই।’
‘আমি আসমার চাচী।’
তুষার চুপচাপ চেয়ারে বসে পড়লেও মিলন বারবার উঁকি দিচ্ছে ভেতরে। আসমার মুখটা এক ঝলক দেখেওছে।
‘আমি জানি আপনারা কেন আসছেন।‘
আসমার চাচীর গলার ক্ষোভটা কান এড়াল না তুষারের।
তবে উনি আর কথা বললেন না।
রইসু নামের মধ্যবয়সী লোকটা এল একটু পর। মিলন ও তার বন্ধুকে দেখে চমকে উঠল। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিতে সময় নিল না।
‘কী চান আপনেরা?’
‘আসমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’
‘কী কাম তার লগে?’
এবার মুখ খুলল তুষার। ‘তার ছবি আঁকার বিষয়টা নিয়ে গ্রামে একটা গুজব রটেছে। এটা ভেঙে দেয়া জরুরি। তা না হলে…’
রইসু স্থির। ঢিলটা জায়গামত লেগেছে দেখে খুশি তুষার। মিলনও আমতা আমতা করে বলল, ‘হুম। আসলে এটা যে একটা গুজব, সেটা না জানলে পরে আসমা গ্রামেই থাকতে পারবে না। ওর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এ নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখি দরকার।’
রইসু কিছু বলতে যাবে, তার আগেই স্ত্রীর ইশারায় ভেতরে গেল। সম্ভবত আসমার চাচী তাকে বুঝিয়ে দিল যে তুষারদের কথাই ঠিক।
‘আইচ্ছা, ঠিকাছে। এখন কী চান?’
তুষার বলল, ‘আমি শুনলাম, আসমা যার ছবি আঁকে, সে নাকি মারা যায়। হে-হে, তো, আমার একটা ছবি আঁকুক না?’
‘ফাইজলামি করেন?’
স্ত্রীর চোখে চেয়ে আবার শান্ত হয়ে গেল রইসু। ওদিকে দরজার আড়ালে দাঁড়ানো আসমাকে ইশারায় ডাক দিল মিলন। আসমার হাতে পেনসিল ও খাতা।
তিন
গ্রামে খবর ছড়াতে সময় লাগে না। এর জন্য অবশ্য মিলনের দোষ নেই। চালাকিটা তুষারেরই। রইসুর সঙ্গে তাদের কথাবার্তা শুনছিল পাশের কয়েকজন ছেলে আর বয়স্ক মহিলা। তুষার তাদের শুনিয়ে শুনিয়েই বলেছে, আসমা তার ছবি আঁকবে ভরা মজলিসে। গ্রামের অনেকেই থাকবে। এবং সে দেখিয়ে দেবে আসমাকে নিয়ে ঘটনাটা গুজব ছাড়া কিছুই নয়।
আসমাকে নিয়ে এরমধ্যে বেশ ক’টি গল্প শোনা হয়ে গেছে তুষারের। গ্রামের লোকজনই বলেছে।
‘আসমার বয়স যখন পাঁচ। তখন থেকে আচমকা ছবি আঁকা শুরু। যা দেখে হুবহু আঁইকা ফালায়। আমরা তো খুশি। এমুন এক গুণবতী আমাদের গেরামে! কিন্তুক, একবার সে আমার ছাগলটার ছবি আঁইকা ফেলল। ওই দিন রাতেই তড়পাইতে তড়পাইতে ছাগলটা আমার মইরে গেল।’
আরেকজন বলল, ‘ক্যান! আসমার বাপের কথা কও!’
নড়েচড়ে বসল তুষার। বেড়েছে মনের খচ খচানি। -’ওর বাপও আপনার মত বাজি ধরসিল। গেরামে সবাই কয় আসমার উপরে একটা কিছু ভর করসে। কিন্তুক, হের বাপে বিশ্বাস করত না। আসমারে ধমকাইয়া-টমকাইয়া কইল, বেটি, তুই এখন হগ্গলের সামনে আমার ছবি আঁকবি! হুবহু আঁকবি!’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কী! রাইত না পার হইতেই বেডা কাইত!’
‘কীভাবে মারা গেলেন উনি?’
‘রাইতে মসজিদ থেইকা আসার পথেই সাপে কাটল। আহা রে, জোয়ান মানুষটা। মা তো আগেই গেছে। এরপর বাপ। তারপর থেইকা রইসুর কাছে থাকে আসমা। কেমুন জানি চাচা লাগে তার।’
‘আচ্ছা।’ হাঁফ ছাড়ল তুষার। কাকতালীয় শব্দটাকে বেশ ক্ষমতাধর মনে হচ্ছে।
মিলনের আগ্রহের কমতি নেই। সে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আরও গল্প আদায় করে নিতে ব্যস্ত।
.
সময় ঠিক হলো বিকাল চারটা।
গ্রামের অনেকেই এসেছে। সবার মাঝে উৎসবের আমেজ। এর মধ্যে চা-মুড়ি পর্বও হয়েছে। আসমা সেজেগুজে বসে আছে উঠোনে। তার হাতে পেনসিল আর ড্রয়িং বোর্ডে লাগানো সাধারণ একটা কাগজ। মুখোমুখি চেয়ারে সটান বসে আছে তুষার। এরমধ্যে নিজের ক্যামেরায় আসমার একটা ছবিও তুলে নিল।
শুরু হলো ছবি আঁকা। বসে আছে তুষার। দশ মিনিটের মধ্যেই আঁকা শেষ। সবাই তাকাল তুষারের দিকে। পিনপতন নীরবতা। আচমকা বুকে হাত দিয়ে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলল তুষার।
লাফিয়ে উঠল মিলন। ‘তুষার! তুষার!’
হই-হই রব উঠল দর্শকদের মধ্যে।
আসমা মাটির দিকে তাকিয়ে আছে চুপচাপ। কেমন যেন রাগে ফেটে পড়ছে তার চোখ। বোর্ড থেকে খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল কাগজটা।
অভিনয়টা বেশিক্ষণ জারি রাখল না তুষার। বাচ্চা মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে তিরস্কার করল। সবার দিকে তাকিয়ে সলজ্জ হেসে বোঝানোর চেষ্টা করল, আসমার বিষয়টা কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু আসমার রাগী চেহারাটা কিছুতেই তাড়াতে পারছে না মন থেকে। কুড়িয়ে নিল ছবি আঁকা কাগজটা। অবাক হলো। মেয়েটা অসাধারণ আঁকে। একদম যাকে বলে ফটোরিয়েলিস্টিক। ছবিটা ভাঁজ করে বুকপকেটে রেখে দিল তুষার।
সন্ধ্যা ঘনাতেই খালি হয়েছে রইসুর উঠোন। কাউকে তেমন অবাক বা হতাশ হতে দেখা গেল না। মিলন অস্থির চিত্তে পায়চারি করছে আর বারবার একই কথা আওড়াচ্ছে, ‘সঙ্গে সঙ্গে কেউ মারা যায়নি। চব্বিশ ঘণ্টার মামলা আছে। এখন মাত্র একঘণ্টা গেছে। তুই কাজটা ঠিক করিস নাই! আমি এখন তোরে কই নিয়া যাই রে, বন্ধু!‘
‘কোথায় নিয়ে যাবি?’
‘ঢাকা এখান থেকে দশ ঘণ্টার পথ। তোর এখন কিছু হলে হাসপাতালে নিতে হইব।’ আহত দৃষ্টি মিলনের। যেন চোখের সামনে জলজ্যান্ত বন্ধুটাকে মরতে দেখছে।