ঈশিতাকে সামনা-সামনি দেখার দিনক্ষণ ঠিক করতে বলেছিলেন সুলতানা বেগম। সেটি ঠিক হয়েছে। আজ সন্ধ্যায় ঈশিতাদের বাসায় গিয়ে দেখবেন। সুলতানা বেগম চেয়েছিলেন কোনও রেস্টুরেন্ট বা পার্কে গিয়ে দেখতে। কিন্তু তাতে ঈশিতা বা ঈশিতার মা রাজি হয়নি। ঈশিতাকে দেখতে হলে তাদের বাসায় গিয়েই দেখতে হবে। ঈশিতা বাসার বাইরে নেকাব তুলে মুখ বের করে না।
অগত্যা ঈশিতাকে দেখার জন্য সুলতানা বেগম তাদের বাসায় যেতে রাজি হয়েছেন। সঙ্গে সুমনকেও নিয়ে যাবেন। তাঁর পছন্দের চেয়েও সুমনের পছন্দটা বেশি জরুরি। যাকে পছন্দ করে বউ বানিয়ে আনা হবে, তাকে নিয়ে সারা জীবন সুমনকেই ঘর করতে হবে। তাই সুমনের ভাল লাগা-মন্দ লাগাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে সুমন যে ধরনের মুখচোরা লাজুক স্বভাবের ছেলে, তাতে সুলতানা বেগমের কথার উপর কোনও দিনও সে টু শব্দটিও করবে না। সুলতানা বেগমের সিদ্ধান্তই সে চূড়ান্ত হিসেবে মাথা পেতে নেবে।
.
সন্ধ্যা সোয়া সাতটা। সুলতানা বেগম তাঁর ছেলে সুমনকে নিয়ে ঈশিতাদের বাসায় এসেছেন। সঙ্গে শাহজাহান ঘটকও রয়েছে। তাঁরা বসার ঘরে বসেছেন। তাঁদের সামনে শরবত থেকে শুরু করে কয়েক ধরনের পিঠা-পায়েস, ফল, মিষ্টি সহ অনেক কিছু পরিবেশন করা হয়েছে। বয়স্কা একজন কাজের মহিলা একটার পর একটা এনে সামনে দিচ্ছে।
সুলতানা বেগম এবং সুমন দু’জনেই হাত গুটিয়ে বসে আছে। এখন পর্যন্ত কিছুই তারা মুখে দেয়নি। পুরানো একটা রীতি আছে, মেয়ে দেখার আগে মেয়ের বাড়ির কিছুই খেতে হয় না। মেয়ে দেখে পছন্দ হলে, প্রথমে মেয়েকে মিষ্টি মুখ করিয়ে খাবার মুখে দিতে হয়। তবে শাহজাহান ঘটক থেমে নেই। সে গপা-গপ চালিয়ে যাচ্ছে।
ঈশিতার মা ইয়াসমিন বেগম তাঁর মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বসার ঘরে ঢুকলেন।
ঈশিতার পরনে লাল রঙের শাড়ি। মাথায় ঘোমটা। বেশ লম্বা মেয়েটা। সেই তুলনায় ঈশিতার মাকে খাটই বলা চলে।
ঈশিতাকে দেখে বিস্ময়ে সুলতানা বেগম ঢোক গিললেন। কোনও মেয়ে যে এতটা সুন্দরী হতে পারে তা তাঁর কল্পনায়ও ছিল না। যেন স্বর্গের অপ্সরা! একেবারে নিখুঁত চেহারা। স্বচেয়ে সুন্দর তার চোখ দুটো। ফটোতে চোখের মণি সবুজাভ মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ঘন কালো। ফটোতে তার চেহারা যতটা গোলগাল মনে হয়েছে, এখন ততটা গোল মনে হচ্ছে না। যথেষ্টই মানানসই। ফটোতে গায়ের রঙ শ্বেতী রোগীর মত অতিরিক্ত রকমের সাদা মনে হয়েছে। এখন সেরকম লাগছে না। হালকা গোলাপি আভা রয়েছে। যাকে বলে দুধে-আলতা গায়ের রঙ।
মোদ্দা কথা, ফটোতে তাকে যতটা সুন্দরী মনে হয়েছে, বাস্তবে সে তারচেয়েও হাজার গুণ সুন্দরী।
মা-মেয়ে সুলতানা বেগমদের মুখোমুখি সোফায় বসেছে। সুলতানা বেগম ঈশিতার উপর থেকে চোখ সরিয়ে ঈশিতার মা ইয়াসমিন বেগমের মুখের দিকে তাকালেন। ভদ্রমহিলার চোখে চোখ পড়তেই তিনি ভয়ানক চমকে উঠলেন। মনে হলো ওই চোখ দুটো তাঁর অনেক দিনের চেনা। এর আগেও কোথায় যেন ওই চোখ দুটো দেখেছেন। বহুবার দেখেছেন!
ভদ্রমহিলার চেহারাও সুলতানা বেগমের কাছে খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। যেন বহু বছর পর এক সময়ের অতি পরিচিত কারও দেখা পেয়েছেন।
সুলতানা বেগম গলা খাঁকারি দিয়ে ইয়াসমিন বেগমকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার সঙ্গে এর আগে কি কোথাও দেখা হয়েছে?’
ইয়াসমিন বেগম কিছুটা অবাক গলায় বললেন, ‘আপনাকে দেখার পর আমিও সে কথাই ভাবছি। এর আগে কি আপনার সঙ্গে কোথাও পরিচয় হয়েছিল? খুব পরিচিত মনে হচ্ছে আপনাকে!’
শাহজাহান ঘটক এক গাদা খাবার মুখে হাউ-হাউ করে বলল, ‘দুনিয়ার সব ব্যাটা ছেলেই হইছে ভাই-ভাই আর মেয়ে ছেলেরা হইছে বইন-বইন। এই জন্যেই চেনা-চেনা মনে হইতেছে।’
সুলতানা বেগম বললেন, ‘আপনাদের আত্মীয়-স্বজন কাউকে দেখছি না।’
ইয়াসমিন বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমাদের নিকট আত্মীয় বলতে কেউ নেই। আমি আমার বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে ছিলাম। বাবা-মা গত হয়েছেন বহু বছর আগে। আর ঈশিতার বাবার দিকের কোনও আত্মীয়- স্বজনের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই।’
সুলতানা বেগম বললেন, ‘ঈশিতার বাবার সম্পর্কে তো কিছুই জানলাম না? বায়োডাটায় দেখলাম শুধু লেখা বাবা নেই। বাবার নাম-পরিচয় কিছুই দেয়া নেই। বেঁচে থাকতে তিনি কী করতেন সে বিষয়েও কোনও উল্লেখ নেই।’
ইয়াসমিন বেগম থমথমে মুখে বললেন, ‘বিয়ে-শাদির ব্যাপার বলে কথা, কিছুই লুকাব না। সবই আপনাদের জেনে রাখা ভাল। ঈশিতার বাবা আমাদের থেকে আলাদা থাকতেন। মৃত্যুর খবরটা পর্যন্ত লোক মুখে জানতে পারি। আমাদের বিয়ের শুরু থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার বনিবনা হচ্ছিল না। ঈশিতার জন্মের পর পাকাপাকিভাবে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। ঈশিতাকে আমি একাই মানুষ করেছি। ও ওর বাবাকে কোনও দিন দেখেওনি। আমি আমার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় পৈতৃক সূত্রে অনেক ধন-সম্পদ পেয়েছি। তা দিয়ে আমার মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করতে খুব একটা কষ্ট হয়নি।’
সুলতানা বেগম বললেন, ‘ঈশিতা তো এবার অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ছে। বায়োডাটায় দেখলাম খুবই ভাল ছাত্রী। এস. এস. সি. এইচ. এস. সি.-র রেজাল্ট অত্যন্ত ভাল। পড়াশোনা শেষ করার আগেই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?’