এবার তানি মেয়েদেরকে জড়িয়ে ধরে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
টিক্-টিক্-টিক্-টিকটিকি ডাকছে। তানি হেসেই চলেছে। শফিক বলল, ‘তোদের মা খেপেছে রে, এত রাতে মান-ইজ্জত আর থাকল না। দরজা-জানালা বন্ধ কর।’
তানি কী করে বলবে শফিককে, মজিদ মিয়া আর। জীবনেও তোমার হাতে ধরা পড়বে না। গয়নাগুলোর সাথে যে বিনিময় করা হয়েছে সন্তানদের সুস্থতা। তানি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে, এ গয়না তার এমনিতেই যেত। মজিদ মিয়া উছিলা হয়ে এসেছিল মাত্র। টিকটিকির সাথে তানির সম্পর্ক সত্যি এক ব্যাখ্যাহীন বাস্তবতা-যা ঘটেই চলেছে…!
পোর্ট্রেট – ধ্রুব নীল
এক
রাত সাড়ে দশটা।
বছর দশেক হবে মেয়েটার বয়স। মায়াবি চোখ। কোঁকড়া চুল। চোখে ঘুম ঘুম ভাব। ঘুণে ধরা টেবিলের সামনে নড়বড়ে এক চেয়ারে বসে অপেক্ষা করছে কারও জন্য। ছোট্ট ঘরটায় অল্প পাওয়ারের বাতির মিটমিট আলো তার ঘুমটা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে যেন। যে করেই হোক জেগে থাকতে হবে।
অপেক্ষার পালা শেষ হলো আধঘণ্টা পর। দরজা খোলার শব্দ শুনেই বুঝল, চুপিসারে ঢুকেছে কেউ একজন। মেয়েটা সচকিত। ড্রয়ার খুলে পেনসিল আর খাতা নিয়ে টেবিলে রাখল ঝটপট। পেনসিলের ডগাটা পরখ করে নিল। একদম তৈরি ওটা। শার্পনার আর ইরেজারও হাতের নাগালে। মেয়েটার পেছনে এসে দাঁড়াল লুঙ্গি আর পুরনো সোয়েটার পরা মধ্যবয়সী লোকটা। যে কিনা একটু আগেই ঘরে ঢুকেছে। কোনও কথা না বলে হাতের মোবাইল ফোনটা রাখল মেয়েটার সামনে। স্ক্রিনে এক যুবকের ছবি। ঘাড় বাঁকিয়ে ছবির দিকে তাকাল মেয়েটা। তাকিয়েই রইল। চোখ আর ফেরাল না। খাতার ওপর চলতে শুরু করল পেনসিল। কখনও খসখস শব্দ, কখনও আলতো করে ঘষছে পেনসিল আর ইরেজার। আলো-ছায়ায় ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে অবয়ব। মিনিট দশেকের মধ্যেই শেষ হলো আঁকা। দুটো ছবি মিলিয়ে দেখল পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা। মুখের হাসিই বলে দিল, একদম নিখুঁত হয়েছে পোর্ট্রেটটা। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘এইবার হারামি বুঝব কব্বরের আযাব কারে কয়।’
মেয়েটা হাসল না। তার চোখে ঘুম।
‘আমি ঘুমাই, চাচাজি?’
‘ঘুমা রে, মা, ঘুমা। কাইল তোরে এক প্যাকেট চকলেট কিনা দিমু। এখন আরাম কইরা ঘুম দে।’
দুই
‘তুই রহস্য গল্প লিখিস বলে ঘটনা তোরে কইলাম। খুব বেশি লোকে কিন্তু জানে না। জানলে বিশাল ঘটনা বেধে যাবে।’
‘গুড। ভাল করেছিস আমাকে বলে। এখন এটা নিয়ে একটা গল্প লিখি আর বলে বেড়াই, সত্য ঘটনা অবলম্বনে। তখন গোটা দেশ জেনে যাবে। হা-হা-হা।’
রহস্য গল্প লেখক তুষার ইশতিয়াক এসেছে তার বন্ধু মিলনের গ্রামের বাড়ি নিশিন্দাপুরে। মাথায় ঘুরছিল একটা থ্রিলারের প্লট। কিন্তু মিলন নাছোড়বান্দা। সে তার গল্পটা নিয়েই আছে। নিশিন্দাপুরে তিনকোনার মাথা বলে একটা জায়গা আছে। সেখানে আসমা নামের বছর দশেকের এক মেয়ের কী এক গোপন রহস্য জেনে ফেলেছে ও। এসেই বলে বসল অদ্ভুত কথাটা: ‘মেয়েটার ভয়ানক ক্ষমতা আছে। ছবি এঁকে মানুষ মেরে ফেলতে পারে।’
‘শুধু মানুষ? গরু-ছাগল এসব মারতে পারে না?’
‘তোদের মত অতি শিক্ষিতদের নিয়ে এই এক সমস্যা। আমিও দু’চার কলম বিজ্ঞান পড়েছি। স্কুলে বাংলা পড়াই বলে যে ফিজিক্স কিস্তু বুঝব না এমন ভাবার কারণ নাই। তুই দেখতে যাবি কি না বল! আর হ্যাঁ, যার ছবি আঁকে, সে-ই মারা যায়। এটা ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে, কেউ ভয়ে কিছু বলে না। যদি আবার তার ছবি এঁকে ফেলে?’
‘কী দেখব? মেয়েটা ছবি আঁকছে আর মানুষ মরে যাচ্ছে?’
‘দেখ, ঘটনা কিছু আছে এর মধ্যে। মেয়েটা স্কুলে যায় না। কেউ তার সঙ্গে মেশেও না। ওর হাতে কাগজ-কলম দেখলে লোকে এক শ’ হাত দূর দিয়ে হাঁটে।’
‘কী ভয়ানক!’
‘অবশ্যই ভয়ানক!’
‘আমি মেয়েটার কথা বলছি না! সবাই ওর প্রতি যে আচরণ করছে, সেটা ভয়ানক।’
‘তোর মাথা! আগে দেইখা আয় নিজের চোখে।’
মিলনের চেহারা দেখে আর কথা বাড়াল না তুষার। মনের খচ-খচানিও আছে বৈকি। ভুতুড়ে রহস্য ছাড়া গ্রামে ঘোরাঘুরিটা ঠিক জমে না।
দুপুরে খেয়ে বের হলো দুই বন্ধু। মাইলখানেকের হাঁটাপথ। পথে যেতে কানে এল কান্নার রোল। আশপাশে মারা গেছে কেউ।
‘মোটরসাইকেল অ্যাক্সিডেন্ট। লোকাল এক নেতার ছেলে,’ বলল মিলন। ‘চৌধুরী সাবের পোলা। নাম বকুল। বদের হাড্ডি ছিল। যদিও মারা গেছে, তারপরও না বইলা উপায় নাই। ওর যন্ত্রণায় গ্রামের কয়েকটা মেয়ের স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আরও অনেক কেস। চল, একটু দেখে আসি।’
‘নাহ, আমার ইচ্ছা নাই।’
‘আরে, ভয়ের কারণ নাই। ধাক্কা লেগে শুধু মাথার খুলি খানিকটা ফেটেছে। ভয়ানক কিছু না।’
তুষার জানে, বাধা দিয়ে লাভ নেই। মিলনের সব কিছুতেই অতি আগ্রহ।
লাশের চেহারা স্বাভাবিক। বয়স ত্রিশের ঘরে। লাশ দেখা শেষে দু’জনে চলে গেল তিনকোনার মাথার একপ্রান্তে পড়ে থাকা ছোট টিনের চালার বাড়িটায়। উঠোন ভর্তি গাছগাছালি। কলতলার আশপাশে ঝোপঝাড়। ভুতুড়ে আবহ তৈরির জন্য যথেষ্ট।
‘রইসু ভাই আছেন?’
অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর এক নারীকণ্ঠ শুনতে পেল দু’জন। ‘উনি বাড়ি নাই। পরে আসেন।’
‘আমার সঙ্গে ঢাকা থেকে সাংবাদিক এসেছেন। তিনি আসমার আঁকা ছবি দেখতে চান। শহরের পত্রিকায় ছাপবেন। আমরা উঠোনে বসলাম।’