.
ফোন বাজছে। শফিক ফোন করেছে। ‘শুনেছ? এই মজিদ ভাইয়ের জ্বালায় তো মরে গেলাম।’ খুব বিরক্ত হয়েই শফিক বলল। ‘তুমি কি কিছু করতে পারবা?’
‘সে আবার কী? আমার কোন টাকা আছে নাকি?’ তানির জবাব শুনে শফিক ফোনটা রেখে দিল।
রাতে শফিক আবার বলল, ‘তুমি কি মজিদ ভাইকে কোন সাহায্য করতে পার? আটাশ কোটি টাকা আটকে দিয়েছে ব্যাংক। তার ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে। মহা ফাঁপরে পড়ে গেছে লোকটা। মাত্র সপ্তাহ খানেকের জন্য বিশ লাখ টাকা লাগবে।’
‘বুঝতে পারছিনে আমি কী করতে পারি, আমাকেই বারবার বলছ কেন?’ একটু ঝাঁঝাল স্বরে বলল তানি।
‘তোমার গয়নাগুলো তো লকারেই পড়ে আছে,’ দ্বিধা করে বলল শফিক। ‘মাত্র সাত দিনের জন্য দিলে তো এমন কোন ক্ষতি হবে না। পঁয়তাল্লিশ ভরি মত দিলেই হবে।’
এতক্ষণে বুঝল তানি শফিকের মনোভাব। গয়নার বিষয়টা ওর মাথাতেই ছিল না। কারণ ছোটখাট ব্যবসায়িক বিপদে শফিক অনেকই পড়ে। কিন্তু কখনও সে গয়নার কথা বলেনি। এই প্রথম, তাও অন্যের বিপদে স্ত্রীকে ওগুলো দিতে বলল।
তানি বুঝল, সত্যি খুব কঠিন অবস্থা মজিদ সাহেবের। আর শফিক যে লোকটার প্রতি দরদী হয়ে উঠেছে, সেটা তানির কাছে খারাপ লাগল না। অনুভূতিশীল মানুষ ওর ভীষণ পছন্দ। তানি সবসময় মানুষকে সাহায্য করতে পছন্দ করে। সম্পদ জমিয়ে রাখা ওর সবচেয়ে অপছন্দ।
একটু ভেবে বলল ও, ‘ঠিক আছে, দেব, কিন্তু আমি যে সাত দিনের মধ্যে ওগুলো ফেরত পাব, তার গ্যারান্টি কত পার্সেন্ট?’
‘একশো পার্সেন্ট,’ শফিক বলল।
তানি উঠে গিয়ে একটা কলম আনল, তারপর দরজায় লিখল, সাত দিনের মধ্যে মজিদ ভাইকে দেয়া আমার পঁয়তাল্লিশ ভরি গয়না ফেরত পাব, একশো পার্সেন্ট গ্যারান্টি।
সকাল বেলা কলিং বেল শুনে দরজা খুলল তানি। অবাক হয়ে বলল, ‘মজিদ ভাই, আপনি?’
অনেকগুলো প্যাকেট তানির হাতে দিয়ে সে বলল, ‘আপনি আমার ছোট বোনের মত, রাতে শফিক ভাই জানাল আপনি বিপদ থেকে আমাকে বাঁচাচ্ছেন। জীবন দিয়ে আপনার এ উপকারের সম্মান রাখব আমি ইনশাল্লাহ্!’
তানি কিছুই না বলে তৈরি হয়ে এল লকার থেকে গয়নাগুলো তুলে আনার জন্য।
‘মজিদ ভাইয়ের গাড়িতেই চলো,’ শফিক বলল।
ফলগুলো টেবিলে রাখতেই টিকটিকি ডেকে উঠল: টিক্- টিক্-টিক্। তানি একটা অদ্ভুত ম্লান হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেল।
সাত
টুবুনের বয়স এখন পনেরো বছর। পড়ে ক্লাস নাইনে, বুবুন বিশ। পড়ে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে। সেই পাঁচ থেকে পনেরো। মাঝে দশটি বছর চলে গেছে। অদ্ভুত ব্যাপার, এ দশ বছরে, একটিবারও দু’মেয়ের অসুস্থতার জন্য চোখের পানি ফেলতে হয়নি তানির। আর কখনও শ্বাসকষ্ট হয়নি টুবুনের।
শফিকের ব্যবসাতেও এখন আর অমন জাঁকজমক নেই। যে শফিক এক সময় বউকে দশ ভরি গয়না একসাথে কিনে সারপ্রাইজ দিয়েছে, এখন কেনা সম্ভব নয় আর। এটা শুধু ওর একার অবস্থা নয়, সমগ্র গার্মেন্টস শিল্পেই নেমেছে এই ধস। ওর সমসাময়িক যে প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গেছে। অসম্ভব পরিশ্রমী আর আত্মবিশ্বাসী শফিক আজও ধরে আছে তার ধসে যাওয়া ব্যবসার হাল। তবুও তানির কোন আক্ষেপ নেই খুইয়ে ফেলা গয়না নিয়ে। যদিও বড় হয়ে উঠছে দু’মেয়ে। দেখতে-দেখতেই ওরা হয়ে উঠবে বিয়ের যোগ্য। তানির বিশ্বাস ওর মন্দ কিছু ঘটবে না। হয়তো অত গয়নাগাটি মেয়েদের দিতে পারবে না, তবু ওদের অমঙ্গল হবে না।
আট
দুই মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ। কিছুক্ষণ আগে স্বর্ণা গেল। ওর স্বামী জহির সাহেব ব্যাঙ্কার। পোস্টিং হয়েছে ঢাকার বাইরে। ছেলে সাদ, ঘুমিয়ে পড়ে সকাল-সকাল। দুই বন্ধু এখন অনেকটা সময় নির্ভেজাল কাটাতে পারে। তানির টিকটিকি বিষয়ক গল্পটা শুনে স্বর্ণা বিনা মন্তব্যে উঠে চলে গেল। তানি বুঝল, স্বর্ণাও হয়তো মনে-মনে ওকে বলল, ‘হুম, ভারি দিলদরিয়ার কাজ করেছ তুমি!’
.
তানি বই পড়ছিল। মাঝরাত্রি পর্যন্ত স্বামীর জন্য অপেক্ষা আগের মতই। শফিক ফিরল রাত একটায়। খেতে-খেতে সব সময়ের মতই বলল ও, ‘বুঝলে, বউ, গয়নাগুলো তুমি একদিন না একদিন ফেরত পাবেই। শুনেছি যাকাত না দিলে ওসব মানুষের থাকে না। আমি সব সময় হিসাবের টাকার চেয়েও বেশি যাকাত মানুষকে দিইনি, বলো? ওগুলো আমার রক্ত পানি করা পরিশ্রমে কেনা জিনিস। মজিদ ব্যাটা একদিন না একদিন দেখবে ঠিকই আমার হাতে ধরা খাবে। কতদিন আর ও চোরের মত লুকিয়ে চলবে? আর তুমিও কেমন মেয়েলোক, সারাজীবন শুনলাম মেয়েরা স্বামীকে ছেড়ে দিলেও গয়না ছাড়তে চায় না। সবাই তো দেখি আমার চাইতে তোমাকেই বেশি দোষ দেয়। ও, ভুলেই গেছি তুমি তো আবার মহিলা হাতেম তাই, মহিলা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহা দার্শনিক!’,
দশটি বছর এই কথাগুলোই বলে চলেছে শফিক। তানির খুব খারাপ লাগে। ও একটা অপরাধবোধ নিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে। সাথে-সাথে একটা টিকটিকি ডেকে ওঠে, ‘টিক্-টিক্-টিক্।’
শফিক বলল, ‘নাহ্, তোমার দোস্ত টিকটিকিগুলোর জ্বালায় দেখি কথা বলেও শান্তি নেই। আর অদ্ভুত ঘটনা! সারা ঢাকা শহর খুঁজলেও মনে হয় এরকম গুইসাপ সাইজের টিকটিকি দেখা যাবে না কোথাও। ওরা কেমনে তোমাকে খুঁজে পেল? –
তানি হাসতে থাকে জোরে-জোরে। রাতে হাসির শব্দে ঘুম থেকে উঠে আসে টুবুন আর বুবুন। বলে, ‘কী হয়েছে, মা? এত জোরে-জোরে হাসছ কেন?’