বিদ্যুৎ গেলে যখন পুরো এলাকাটা অন্ধকারে ঢেকে যায়, তখন আশপাশের বাড়ি থেকে লোকজন বেরিয়ে ঢিবিটার কাছে এসে দাঁড়ায়। কিছু বুনো ফুলের গাছ আর বিশাল একটা খেজুর গাছ জায়গাটাকে মোহময় করে রেখেছে। তানিদের বাড়ির সবার পছন্দের জায়গা ওটা।
কিন্তু তানির বাবা মুহিব সাহেব, সন্ধ্যার পর ও জায়গাটায় যাওয়া একদম পছন্দ করেন না। বলেন, ‘ওখানে কেউ অন্ধকারে যাবে না। সাপ-পোকা থাকতে পারে।’
যদিও এ এলাকায় কখনও সাপ-টাপ দেখা যায়নি।
তানিদের চার ভাই-বোনের প্রিয় জায়গা ওটা। বিদ্যুৎ যাওয়ার সাথে-সাথেই বড় ভাইয়া বাঁশি নিয়ে চলে যায় ঢিবির উপর খেজুর গাছটার তলে। ওরা কয় ভাই-বোনও যায় ভাইয়ার পিছু-পিছু। বাবার নিষেধ অমান্য করে প্রায় প্রতিদিনই।
সেদিনও যথারীতি বিদ্যুৎ চলে গেল। আবছা আলোতে বড় ভাইয়া বাঁশি নিয়ে চলল ঢিবির দিকে। পিছু-পিছু তানি। কাছাকাছি যেতেই লম্বা খেজুর গাছটার মাথায় টিক্-টিক্ করে ডেকে উঠল টিকটিকি।
‘ভাইয়া, সামনে দেখো,’ চেঁচিয়ে উঠল তানি।
‘এই-সাপ-সাপ, তানি, বাড়ি থেকে শিগির একটা লাঠি নিয়ে আয়,’ বলল বড় ভাইয়া।
জীবনে প্রথম জ্যান্ত সাপ দেখল তানি। বিশাল কালো কুচকুচে সাপ।
পরে ভাইয়া সবাইকে বলল, ‘ওটা জাত সাপ ছিল। ভাগ্যিস তানি দেখেছিল। না হলে আমি তো ওটার গায়ে পাড়া দিয়েই ফেলেছিলাম প্রায়।’
সাপ-দুর্ঘটনা হতে বাঁচানোর পুরো কৃতিত্বটা সবাই তানিকেই দিল। শুধু তানি জানে, কৃতিত্বটা ওর নয়, টিকটিকির।
রাতে শুয়ে তানি তাসমিকে বলল, ‘জানিস, আপু, অদ্ভুত ব্যাপার, আমার না ভয় অনেক কমে গেছে। টিকটিকি এখন আমার বন্ধু আবার শত্রুও।’
‘তুই দেখছি ইদানীং টিকটিকি নিয়ে বেশি গবেষণা করছিস!’ তাসমি কৌতুকের স্বরে বলল। ‘জানো, মা, তানিকে না টিকটিকিতে পেয়েছে, সত্যি বলছি, আমি ব্যাপারটা খেয়াল করেছি,’ বলে হাসতে লাগল।
মা কিন্তু মোটেও হাসলেন না। গম্ভীর হয়ে তানিকে বললেন, ‘তোমাকে আয়াতুল কুরসিটা শেখাতে হবে।’
তানি ভয়ঙ্কর ভীতু। এ জগতে তার ভয় পাওয়ার অগণিত উপকরণ রয়েছে। জিন-ভূত, পোকামাকড়, মানুষ, গরু, কুকুর সব কিছুকেই তার ভয়। অদ্ভুত ব্যাপার, শুধু টিকটিকি নামের প্রাণীটিকে তার কখনওই ভয় লাগেনি। শুধু ওর ডাকটা এখন…
মনে-মনে মেলাতে চেষ্টা করে তানি, টিকটিকি কি ওর বন্ধু না শত্রু? কারণ ভাল-মন্দ যা-ই ঘটছে তারই সঙ্কেত দিচ্ছে।
অবশ্য দুই বোনই এখন আয়াতুল কুরসি শিখে নিয়েছে। মায়ের কথামত তিনবার দোয়াটা পড়ে বুকে ফুঁ নেয় ওরা। তবুও তানির ঘটেই চলেছে অদ্ভুত কিছু। যেমন, কাল যখন ও গোসল করছিল, কোথাও একটা টিকটিকি ডেকে উঠল। সাথে-সাথে সতর্ক হলো। যা সন্দেহ করেছিল, গোসলখানার এক কোনায় নাদুস নুদুস একটা কেঁচো। আর যায় কোথায়, এক চিৎকার দিয়ে দরজা খুলে ভোঁ-দৌড়। টিকটিকির সাথে তানির যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে বাড়ির সবাই তা জেনে গেছে। ওটা নিয়ে বড় ভাইয়া খুব মজা করে বলে, ‘চোখে তিল তানি, গজ দাঁত তানি, খেংরা কাঠি তানি, টিকটিকির দোস্ত তানি।’ আর তানি কেঁদেকেটে অস্থির।
মা বললেন, ‘তুমি এখন থেকে আর টিকটিকি বিষয়ক কোন কথা কাউকে বলবে না। এটা মনে রেখো, তোমার যা ঘটছে তা শুধু হাসি-ঠাট্টার ব্যাপার না। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক।’
তানি বুঝতে পারল, মা এটাকে মোটেও স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন না। আর বিষয়টাকে গুরুত্বও দিচ্ছেন যথেষ্ট।
ছয়
শফিকের ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। এটা ওর প্রতিদিনের রুটিন। তবু তানি স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে সেই সন্ধে থেকেই। বাচ্চাদের দায়িত্ব সেরে যেটুকু সময় পায়, ওর পছন্দের কাজগুলো করে। তবে আজ আর অপেক্ষা করে বসে নেই ও। ভীষণ ক্লান্ত। গত কয়েক রাত টুবুনের কাশিতে একটুও ঘুম হয়নি। শফিক এসে দেখল, দুই মেয়েকে দু’পাশে নিয়ে তানি বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। এমনিতে সব সময়ই কোন অসুস্থতার পর বুবুন-টুবুন যখন সুস্থ হয়, তানি তখন পরম শান্তি অনুভব করে।
ফোনে শফিক জেনেছিল, টুবুনের কাশিটা কমে গেছে। বাসায় সে-ও এল খুব ফুরফুরে মেজাজে। খাওয়া সেরে বিছানায় যেতে ওদের রাত দুটো বেজে গেল। যদিও শফিক কখনওই বউয়ের বন্ধু নয়, কিন্তু ঘুমের সময় বউকে তার চাই। তানির গায়ের উপরে হাত না দিলে তার ঘুম হয় না।
শফিক বউকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘জানো, মজিদ ভাই না খুব বিপদে পড়েছে। আজ ফ্যাক্টরিতে এসে আমার কাছে খুব কান্নাকাটি করছিল। সামান্য কিছু টাকার জন্য তার বিশাল একটা পেমেণ্ট আটকে গেছে। আমার কাছে টাকা চায়। কত করে বললাম, আরে, আমি অত টাকা কই পাব এখন!’
‘আহা রে, বেচারা! সত্যি যদি সেরকম টাকা থাকত তাহলে তো দেয়াই যেত। তুমি তাকে বলেছ না, ক’দিন আগে এক কোটি টাকার মেশিন নগদ টাকায় এনেছ। এখন কোন টাকাই তোমার নেই। এই জন্য ব্যবসা জিনিসটাই ভাল্লাগে না আমার। এত বড় গার্মেন্টসের মালিক, তাকেও টাকার জন্য হাত পাততে হয় অন্যের কাছে।’
তানি মজিদ সাহেবকে চিনেছে কিছুদিন হলো। ক’দিন আগে তার পরিবারের সাথে বেড়িয়ে এসেছে ওরা কক্সবাজার, রাঙামাটি। তখনই ভাল করে পরিচয় হয়েছিল ওদের সঙ্গে। এর আগে শফিকের কাছে শুধু ব্যবসায়ী হিসেবে নাম শুনেছিল মজিদ সাহেবের। এই ভদ্রলোকের সাথে বেশ ভাল ব্যবসায়িক সম্পর্ক তার। ব্যবসার শুরু থেকেই দু’জনের বেশ অন্তরঙ্গতা।