গোসলখানায় কল ছেড়ে দিয়ে মা তানিকে বহুবার কুলকুচি করালেন। সাবান দিয়ে মুখ ধুয়ে দিতে-দিতে বললেন, ‘টিকটিকি বিষাক্ত প্রাণী, এর ডিম তোমার মুখে গেল কী করে?’
‘মনে হয় খাটের আড়ায় ছিল, মশারি খুলতে গিয়ে তানির মুখে পড়েছে,’ বলল তাসমি।
খাটের আড়ার ফাটলে আরও তিনটা ডিম খুঁজে পাওয়া গেল। তানি এর আগে কখনও টিকটিকির ডিম দেখেনি। মা ওগুলো ফেলে দিতে গেলে তানি চেঁচিয়ে বলল, ‘সত্যি বলছি, মা, জীবনেও আমি টিকটিকির ডিম খাব না, আমার মুখে পড়লে থুহ-থুহ করে ফেলে দেব। তুমি ওগুলো কালকে ফেলো, আজকে একটু আমার কাছে রাখি?’
ক্লাস সেভেনে পড়লেও তানিটা একেবারে শিশুদের মত। সারাদিন ডিমগুলো সাবধানে নিয়ে বেড়াল। অঙ্ক করতে গিয়ে বইয়ের উপর রেখেই অঙ্ক করল। আগামীকাল ওর অঙ্ক পরীক্ষা। অনেক খাটল এর পেছনে। অঙ্কটা ওর কাছে যমের মত। ছোটবেলা থেকেই, যে ওকে অঙ্ক নিয়ে প্রশ্ন করবে, ও মনে-মনে তাকে অভিশাপ দেবে, ‘ধ্বংস হোক, তার চোদ্দ গুষ্টি নিপাত যাক।’
এই হলো অবস্থা। প্রথম সাময়িক পরীক্ষাতে চৌত্রিশ পেয়েছিল। মানে টেনেটুনে পাশ। এবার মোটামুটি ভাল না করতে পারলে আর মান-ইজ্জত কিছু থাকবে না। বাদশা স্যর সপ্তাহে চারদিন বাসায় এসে অঙ্ক করিয়ে যান। স্যরের কাছে আজ প্রায় ঘণ্টা তিনেক অঙ্ক করছে। মনে-মনে বলল তানি, ‘এবার মনে হচ্ছে অঙ্ক পরীক্ষাটা ভালই দেব। অনেক খেটেছি…
‘টিক্-টিক্-টিক্,’ সাথে-সাথে একটা টিকটিকি ডেকে উঠল। সেটা অবশ্য তানির খেয়াল করার কথা নয়। এমন কোন ঘর আছে, যেখানে টিকটিকি নেই? সারাদিন কতই তো ডাকছে ঘরময়। আশ্চর্য! এই ডাকটা কিন্তু ওর কানে লাগল। মনে হলো টিকটিকিটা ওকে বিদ্রূপ করল। অবচেতন মনেই দেয়ালের এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগল। যেন টিকটিকির হাসি মুখের চেহারাটা দেখতে পাবে ও।
চার
প্রশ্নপত্র হাতে পেল তানি। মুহূর্তে পুরোটাতে চোখ বুলিয়ে খুশিতে আটখান হয়ে গেল।
সব অঙ্ক কমন পড়েছে! খাতা নিয়ে অস্থির হলো দ্রুত লেখার জন্য। ফিসফিস করে পাশের বেঞ্চে বসা বিউটিকে বলল, ‘বুঝলি? স-অ-ব কমন পড়েছে, হেল্প লাগলে বলিস।’ গর্বে বুকটা ভরে গেল ওর। এমনটাই তো কল্পনা করেছিল। পাজি বিউটিটা গত পরীক্ষায় ওর
ওর দিকে ফিরেও তাকায়নি-হেল্প তো দূরের কথা। সাহায্য না করার অবশ্য অন্য কারণ আছে। ক্লাসের সবচেয়ে চটপটে মেয়ে তানি। তার উপরে, গান, নাচ, ছবি আঁকা, কবিতা লেখা সব কিছুতেই সে ওস্তাদ। তাই অঙ্কে ডাব্বা মারাতে মনে-মনে ও খুশি।
যাই হোক, শান্ত মাথায় লেখা শুরু করল তানি। ক’সেটের সব অঙ্কই দেখল পারে। এক নম্বরটা কোনভাবেই মিলল না ওর। এবার একটু ঘাবড়ে গেল। কেন মিলছে না? এবার অন্যগুলোর দিকে নজর দিল। হায়, খোদা! সব গুলিয়ে গেছে। নিজেকে বোঝাতে লাগল, ‘সব পারি, তবে কেন মিলছে না?’ বাদশা স্যরকে ডেকে বলল, ‘স্যর, আমি একটা অঙ্কও পারছি না।’
স্যর বললেন, ‘তোর মানসিক রোগ আছে। অঙ্কের সিলেবাস তো সব গুলিয়ে খাইয়েছি।’ বলে স্যর চলে গেলেন। তানি প্রাণপণ চেষ্টা করে চলল। কিন্তু একটা অঙ্কও মেলাতে পারল না। প্রায় সাদা খাতা জমা দিয়ে কাঁদতে- কাঁদতে বাড়ি ফিরল বেচারি।
কেবলই ওর মনে হতে লাগল এই লটখটের জন্য ওই টিকটিকির ডিম আর টিকটিকিই দায়ী।
ওর কান্না দেখে বাসার কেউ কিছুই বলল না। বরং আব্বা ওকে সান্ত্বনা দিলেন-’যাক, আর কাঁদিসনে, ভাল করে চেষ্টা কর যেন ফাইনালে গিয়ে ফেল না করিস।’
তানি বলল, ‘আমি কি কখনও ফেল করেছি? আমি তো টি-টি-পি, মানে, টেনেটুনে পাশ। ওই শয়তান টিকটিকিটাই এবার আমাকে ফেল করাল।
পাঁচ
ক’দিন বাদে তাসমির এস. এস. সি. পরীক্ষা। সারাদিন দুই বোন খুনসুটি করে। অতিষ্ঠ হয়ে মা একদিন বললেন, ‘ফাজলামো করে বহু সময় নষ্ট করেছ দুই বোন। এখন থেকে দু’জন আলাদা ঘরে পড়বা।’
তানি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছিল বাইরের ঘরে। কোথাও একটা টিকটিকি ডেকে উঠল।
‘আপু, এই ঘরে আয়, এক্ষুণি কারেন্ট চলে যাবে, ‘ চেঁচিয়ে উঠল তানি। মুহূর্তে সব অন্ধকার।
দু’বোন জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে ওদের রুমে। টেবিলের ওপর টিপটিপ করে মোমের আলো জ্বলছে। তাসমি বলল, ‘তুই তো দেখি অলৌকিক শক্তিওয়ালা হয়ে গেছিস। কী করে বুঝলি যে কারেন্ট চলে যাবে?’
‘আমাকে সিগন্যাল দিয়েছে টিকটিকি। জানিস, আপু, তুই বিশ্বাস কর, আমার পরীক্ষাটা খারাপ হলো ওই পাজি টিকটিকির জন্যে। সেদিন ডিম মুখে যাওয়ার পর থেকে দেখছি, টিকটিকির পাল আমার পিছু নিয়েছে। ভালমন্দ যা- ই ঘটছে, উজবুকগুলো আমাকে টিক্-টিক্ করে জানান, দিচ্ছে!’
‘দূর, বোকা, আমাদের ঘরে তো সারাক্ষণই টিকটিকি…..’
টিক্-টিক্-টিক্।
‘এই দেখ, এখনই ডাকল,’ বলে ছোট বোনের দিকে তাকিয়ে হাসল তাসমি।
তানি কান খাড়া করে বলল, ‘দেখিস কিছু একটা ঘটবে এখন…’ দপ করে আলোগুলো জ্বলে উঠল। ভয়ে তাসমি জড়িয়ে ধরল তানিকে।
তানিদের বাড়িটা শহরতলীতে। দিনরাত এখানে বিদ্যুৎ যাওয়া-আসার খেলা চলে। ওদের বাড়ির কয়েক গজ দূরেই রাস্তা। সন্ধ্যা লাগার কিছুক্ষণ পরেই জায়গাটা কেমন সুনসান নীরব হয়ে যায়। একটু এগিয়ে রাস্তাটা বামে মোড় নিয়েছে। ওই মোড়ের কাছেই আছে একটা উইয়ের ঢিবি।