‘জানতে পারবা, বন্ধু, আমার কিছুই অজানা থাকবে না তোমার।’ রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল তানি।
রুপোর থালার মত বড় চাঁদ উঠেছে আকাশে। রাত প্রায় দশটা বাজে। মোবাইলে সময় দেখল তানি। ঠিক তখনই টিক্-টিক্-টিক্-টবের পাশ থেকে ডেকে উঠল টিকটিকিটা।
‘স্বর্ণা, চলো নেমে যাই, একটা পোড়া গন্ধ নাকে আসছে,’ নাক টেনে বলল ও।
‘হায় সর্বনাশ,’ লাফ দিয়ে উঠল স্বর্ণা। ‘আমি তো চুলায় ভাত দিয়ে এসেছিলাম।’
.
দুই বন্ধু বসে আছে তানির ডাইনিং টেবিলে। ছাদ আর ঘরের টেবিলটাই ওদের আড্ডার স্থান। শফিক জানিয়েছে ফিরতে রাত একটাও বেজে যেতে পারে। স্বর্ণা আরাম করে দুই চেয়ার নিয়ে বসল।
ও বলল, ‘তানি, তোমার টিকটিকি রহস্যটা শুনতে চাই। আজ আমি খেয়াল করেছি তুমি টিকটিকির ডাক শুনেই নিচে নামতে চাইলে, ভাত পোড়ার গন্ধটা পেলে। যে হারে আমরা গল্পে মজে ছিলাম ছাদে, এতক্ষণে কী হত ভাবতেই শিউরে উঠছি। আচ্ছা, বলো তো, তুমি কি কোন বিপদের সিগন্যাল পেয়েছিলে?’
তানি বলল, ‘তোমার মতই আরেকটা দোস্ত আছে আমার। কোন কিছুই তার অজানা নয়।’
‘প্লিজ, তানি, এত রং ঢং না করে বলোই না ঘটনাটা।’
দুই
দশ বছর আগের কথা।
টিক্-টিক্-টিক্!
ট্রিকটিকির এই ডাকটা যেন ওর মনে মুহূর্তেই একটা প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে গেল। যাক, কাজটা তাহলে হচ্ছে, তানি আশ্বস্ত হলো। দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে জায়নামাজ থেকে উঠল ও। টুবুনের কাশিটা মনে হলো কমে আসছে।
বিছানায় এসে মেয়ের মাথাটা বুকের মধ্যে নিয়ে তানি বলল, ‘মাগো, ইনশাল্লাহ্ আর কখনও তোমার ওরকম কাশিটা হবে না। আল্লাহ্ আমাকে ইঙ্গিত দিয়েছেন।’
মায়ের কথা পাঁচ বছরের টুবুন কিছু বুঝল বলে মনে হলো না। তবে সত্যিই কিছুক্ষণ আগে যেভাবে কাশছিল, সেটা কমে গেল।
ছোটবেলা থেকেই এরকম সাংঘাতিক কাশি বাচ্চাটার। কোনভাবে ঠাণ্ডা লাগলে আর রক্ষে নেই। কাশতে কাশতে লাল টকটকে হয়ে যায় চোখ দুটো। যেন ফুটে বেরিয়ে আসবে। মুখ দিয়ে লালা ঝরে অনবরত। খাওয়া-দাওয়া একেবারে বন্ধ। টোটকা, কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি কিছুতেই কাজ হয় না। দেশের নাম করা শিশু বিশেষজ্ঞ, অগুনতি অর্থ ব্যয়, সব বেকার। বড় মেয়ে বুবুনের অসুখ হলে আরও আজব ঘটনা ঘটে তানির। ওর যে অসুখ হবে দেখা যায় তানিরও ঠিক সেটা শুরু হয়। যেমন, বুবুন বমি করলে তার মায়েরও বমি শুরু হবে, জ্বর হলে জ্বর…! সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল যখন বুবুনের চোখে ‘আই ড্রপ’ দেয়া হলো। তানি কাশতে-কাশতে বলল, ‘আমার গলা তেতো হয়ে গেছে, হায়, খোদা, বুবুনের চোখে ওষুধ দিলে আমার গলা তেতো হচ্ছে কেন?’
প্রতি এক-দেড় মাস পরপরই মেয়েদের এত কষ্ট তানিকে সহ্য করতে হয়। যতবারই এমন হয়, ও জায়নামাজে বসে যায়। সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের জীবন থেকে শুরু করে সব সম্পদ বিনিময় করেও দুই সন্তানের সুস্থতা চায়।
তবে বাইরের কেউ তানির মোনাজাত দেখলে পাগল ভাববে নিশ্চিত। ওর দোয়াটা এরকম হয়—’হে, আল্লাহ্, আমার জানটা তুমি নিয়ে নাও, আমার সব গয়নাগাটি তুমি নিয়ে নাও, আমার জমা-জমি, ধন-সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য সব তুমি নিয়ে নাও, আমাকে পথের ফকির করে দাও। আমি আমার সুস্থ মেয়ে দুটোকে নিয়ে গাছতলায় বাস করব। তবু রোগ চাইনে, আল্লাহ্।’ এরপর চলে অঝোরে কান্না।
আর কেনইবা এমন পাগলামি করবে না ও? মাত্র বাইশ বছরেই দুই বাচ্চার মা হয়ে গেছে। দুটো বাচ্চা নিয়ে ধরতে গেলে একেবারে একা। কাছে তো সাহস দেয়ার মত আপনজন, বন্ধু বা ওরকম কেউ থাকে না। আর যদিওবা আপনজন কেউ আসে, তো বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ওর কাণ্ডকারখানা দেখে বিরক্ত হয়ে দ্রুত কেটে পড়ে।
শফিক খুবই ব্যস্ত মানুষ। গার্মেন্টস্ ব্যবসা। রাত নেই, দিন নেই শুধু কাজ আর কাজ। মেয়েরা অসুস্থ হলে সব রাগ গিয়ে পড়ে তানির ওপর। বলে, ‘তোমার নির্বুদ্ধিতার, কারণেই ওদের রোগ হয়। এমনি কি নেপোলিয়ন বলেছেন, ‘আমাকে একটা যোগ্য মা দাও’’…ইত্যাদি, ইত্যাদি। অকারণেই বকা শুনতে হয় বেচারি তানিকে। একে সন্তানের অসুস্থতা তার উপর স্বামীর ভয়ানক আচরণ। বাচ্চাদের সব রকম অসুখের দায় ওদের বাবা নির্দ্বিধায় তানির ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। অসুখ-বিসুখ তাই ওর নিজের মৃত্যুর চাইতেও ভয়ঙ্কর মনে হয়।
আজও ঠিক ওভাবেই মোনাজাত শেষ করেছিল ও। ব্যতিক্রম ঘটল, হাতটা নামাতেই যখন টিকটিকিটা ডেকে উঠল, টিক্-টিক্ করে। টিকটিকি সে তো ডাকতেই পারে। এর মাঝে সন্তানের সুস্থ হবার কী ইঙ্গিত রয়েছে, সেটা তানি ছাড়া কেউ জানে না।
তিন
‘আপু, মশারিটা একটু খুলে দে না,’ পায়ের উপর পা উঠিয়ে বলল তানি।
তাসমি বিরক্ত হয়ে বলল, ‘পারব না, সেই কখন থেকে উঠতে বলছি তোকে। কাল না অঙ্ক পরীক্ষা তোর?’
বোনের কথায় কান দিল না তানি। বরং জোরে-জোরে গাইতে লাগল, ‘সাত ভাই চম্পা জাগোরে জাগোরে, ঘুম ঘুম থাকে না ঘুমেরই ঘো…আপুরে-কী গেল আমার মুখে,’ বলে চেঁচিয়ে উঠল ও।
তাসমি মশারিটা খাটের আড়ায় ভাঁজ করে রেখে বলল, ‘চুপ কর, ফাজিল, তোর মুখে রসগোল্লা গেছে।’
‘না রে, আপু, আমি ফাজলামো করছি না, সত্যি বলছি, আমার মুখে ডিম-ডিম স্বাদ লাগছে।’
‘এই, তোর মুখে টিকটিকির ডিমের খোসা, ও, মা, দেখে যাও, তানি টিকটিকির ডিম খেয়েছে,’ চেঁচিয়ে উঠল তাসমি।