হঠাৎ দৃশ্যপটে এল তৃতীয় এক লোক। পেছন থেকে দেখেও ইফা ঠিক চিনল না মানুষটা কে। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, মানুষটা তার স্বামী-জুয়েল।
জুয়েল?
সে এখানে কী করছে?
ডেইজির ভালবাসার মানুষটা সে?
জুয়েল?
দাঁড়িয়ে আছে জুয়েল। হাতে সিগারেট। খুব শান্ত দেখাচ্ছে তাকেও। মনে হচ্ছে যেন জানত এখানে কী ঘটছে। হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বলল জুয়েল, ‘বন্ধু, পলাশ, যা করছ, তাতে এত তাড়াতাড়ি কেন? তাড়াহুড়োর কিছুই নেই। ডেইজিকে তুমি ছেড়ে দাও। ওর কোনও দোষ নেই। ও যা কিছু করেছে, আমাকে খুশি করার জন্য করেছে।’
ডেইজির গলা ছেড়ে দিল পলাশ। সরে গিয়ে জুয়েলকে জড়িয়ে ধরে চুমো দিল ডেইজি।
অবাক হয়ে চেয়ে আছে পলাশ। ‘তার মানে কী? আমার সাথে এতসব নাটক করলে কেন?’ খুব অবাক হয়ে জানতে চাইল সে।
‘কারণ তুমি আমার শত্রু,’ বলল জুয়েল।
‘আমি তোমার শত্রু? আমি তো তোমাকে কালকের আগে চিনতামও না। আমার সাথে তোমার শত্রুতা কীভাবে?’ আরও বেশি অবাক হলো পলাশ।
‘ব্যবসা করতে গিয়ে আমার অনেক ক্ষতি করেছ,’ বলল জুয়েল। ‘আর তারচেয়েও বড় কথা, তুমি খুব অল্প সময়ে আমার চেয়েও ধনী হয়ে গেছ। বলো, এসব কীভাবে সহ্য করি? চাই না আমাকে টপকে কেউ ওপরে উঠুক। তাই আমার সুন্দরী প্রেমিকাকে কিছু দিনের জন্য তোমাকে দিতে হলো।’
‘আর এ সুযোগে আমার সবকিছু হাতিয়ে নিয়ে আমাকে নিঃস্ব করলে, তাই না?’
‘কারেক্ট, সবকিছু আমার প্ল্যানের ভেতর ছিল, বন্ধু, হাসতে লাগল জুয়েল।
রাগে পাগলের মত জুয়েলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল পলাশ। দু’জনের মধ্যে শুরু হলো ধস্তাধস্তি। এক পর্যায়ে পানির ট্যাংকের সঙ্গে খুব জোরে পলাশের মাথা ঠুকে দিল জুয়েল। কয়েকবার বাড়ি দেয়ার পর জ্ঞান হারাল পলাশ। তখন পলাশকে তুলে রেলিং-এর দিকে নিয়ে যেতে লাগল জুয়েল ও ডেইজি।
এ দৃশ্য দেখে খুব অস্থির হয়ে উঠল ইফা।
রেলিং-এ পলাশকে শুইয়ে দিল জুয়েল ও ডেইজি।
ইফা বুঝল, কী করতে যাচ্ছে ওরা। চিৎকার করে মানা করতে চাইল, কিন্তু কেউই শুনল না ওর চিৎকার।
ডেইজিকে রলতে শুনল, ‘জুয়েল, আমি তোমার সাথে নতুন জীবন শুরু করতে চাই। শুধু তুমি আর আমি।’
‘সে তো তোমার হাতে ডার্লিং। এসো, নিজ হাতে উদ্বোধন করো তোমার নতুন জীবন।’
‘হ্যাঁ,’ এই বলে পলাশকে ধাক্কা মেরে রেলিং থেকে ফেলে দিল ডেইজি।
এ দৃশ্য দেখে চিৎকার করে উঠল ইফা, কিন্তু শুনল না কেউই।
জুয়েলকে বলল ডেইজি, ‘দেখলে, জান, তোমাকে কত ভালবাসি? নিজ হাতে সরিয়ে দিলাম তোমার শত্রুকে পৃথিবী থেকে! এমন ভালবাসা তুমি পৃথিবীর কোথাও পাবে না। হ্যাঁ, ভালবাসা, তার সাথে কোটি-কোটি টাকাও।’
হাসতে লাগল দু’জনই।
জুয়েল ও ডেইজিকে দেখার জন্য তাকাল ইফা, কিন্তু আর দেখতে পেল না কাউকে। রেলিং-এর ওদিকে তাকাল। অনেক নিচে ওখানে কোনও লাশ নেই। আবার ফিরে দেখল, দাঁড়িয়ে আছে পলাশ। অপূর্ব চোখদুটোতে এখন নীলের চিহ্ন নেই। তার বদলে লাল রঙের খেলা। সেই নীল চোখদুটোতে এখন জ্বলছে প্রতিশোধের লাল আগুন।
থমথমে গলায় পলাশ বলল, ‘এতক্ষণ যা কিছু দেখলে, তা এক বছর আগে ঘটে যাওয়া কোনও এক রাতের ঘটনা। ওরা আমাকে এভাবে শেষ করেছিল। সে রাতের পর থেকে আমি অপেক্ষায় আছি আজকের এই রাতের জন্য।’
পরিশিষ্ট
ডেইজিকে পাওয়া গেল তার ঘরে মৃত অবস্থায়। কে যেন তার বুকে বসিয়ে দিয়েছে ছোরা। ওটার বাঁটে পাওয়া গেল জুয়েলের হাতের আঙুলের ছাপ।
দরজা ভেঙে জুয়েলের ঘরে ঢুকতে হলো পুলিসকে। দেখল, বিছানায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে ইফা আর জুয়েল আছে বারান্দায় মৃত। তার বুকেও গেঁথে আছে ছোরা।
এবং বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, ছোরায় পাওয়া গেল ডেইজির আঙুলের ছাপ।
এই দুটি মৃত্যুর রহস্য তদন্ত করে কিছুই বের করতে পারল না পুলিস।
দু’দিন পর জ্ঞান ফিরল ইফার। কিন্তু বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে ও। ইশারায় পুলিসকে বলল: সে কিছুই জানে না। এরপর থেকে ইফা কখনও পলাশ নামের নীল মণির আত্মাকে আর দেখেনি।
টিকটিকি – নাশমান শরীফ
এক
এক টিক্-টিক্-টিক্, ডেকে উঠল টিকটিকি। ‘স্বর্ণা, চলো নিচে যাই,’ শোয়া থেকে এক ঝটকায় উঠে বসে বলল তানি।
ভয় পেয়ে বলল স্বর্ণা, ‘এই, কী দেখেছ তুমি? আমার কিন্তু ভয় করছে।’
তানি তর্জনীটা বাড়িয়ে দেখাল, ‘ওই যে দেখো, শুটিংস্টার।’
দেখতে পেল না স্বর্ণা। তার আগেই পড়ে গেছে ওটা।
‘ছাদটা এখন কিন্তু ভুতুড়ে লাগছে আমার,’ বলল স্বর্ণা।
‘চলো যাই, রাতও হয়ে গেছে অনেক।
পাটি, বালিশ গুছিয়ে নিচে নেমে এল দুই বন্ধু।
একই তলায় মুখোমুখি ফ্ল্যাটে বাস, প্রায় সমবয়সী দু’জন। ওদের বন্ধুত্বের বয়স চলছে দুই বছর। স্বর্ণা এখানে আসার আগে কেউ কাউকে চিনত না। শুরুতে প্রতিবেশী হিসেবে সৌজন্য সম্পর্ক ছিল। এরপর দেখল বহুদিকে ভাললাগা মিলে যায় দু’জনের। যেমন, দু’জনই কবিতা লেখে, গান শুনতে ভালবাসে, একই রকম প্রকৃতিপ্রেমী। আরও অনেক মিল…। আর কী বাধা, ব্যস, হয়ে গেল আপনি থেকে তুমি। সারাক্ষণ দু’দরজা হাট করে খোলা। এক ঘরের মতই বসবাস ওদের। ঘরের দুয়ার খোলা মানে আসলে ওদের মনের দুয়ারটাই খোলা।
‘স্বর্ণা, তুমি কি ছাদে টিকটিকির ডাকটা শুনেছিলে?’ তানি জিজ্ঞেস করল।
স্বর্ণা বলল, ‘আচ্ছা, টিকটিকির সাথে তোমার কী বলো তো? এর আগেও একদিন ছাদে টিকটিকির ডাকে অমন ভয় পেয়েছিলে। মনে হয় কোন রহস্য আছে। তোমার তো আবার মেলা অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার ঘটে।’