সাধ্যমত সান্ত্বনা দিল ইফা।
মহিলা ফুঁপিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘বিশ্বাস করো, মা, আমি আজও জানি না কেন আমার শান্ত ছেলেটা আত্মহত্যা করল। এর কিছু দিন পর জানলাম, আমাদের ব্যাঙ্কে আর কোনও টাকা নেই। আজও জানি না ছেলেটা এত টাকা কী করল বা কোথায় রাখল।’
ইফা জিজ্ঞেস করল, ‘আর মেয়েটি?’
‘মেয়েটিকে আর কখনও দেখিনি।
‘মেয়েটিও আসেনি? আচ্ছা, আন্টি, আপনার ছেলের কোনও ছবি আছে?’
‘হ্যাঁ, আছে। তুমি একটু বোসো, আমি নিয়ে আসছি।’
কিছুক্ষণ পর ছেলের ছবি নিয়ে এল মহিলা।
সেই ছবি দেখতেই কেঁপে উঠল ইফা। চমকে গিয়ে ভাবল: ‘আশ্চর্য, আমি এ কী দেখছি? এসব কী হচ্ছে আমার সাথে? আমাকে এসব কী শুনতে হচ্ছে? এ কি আমার কোনও দুঃস্বপ্ন? এ কি বাস্তব না অবাস্তব!’
ভেবে কিছুই কূল করতে পারছে না ইফা। ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আন্টি, আপনার ছেলের নাম কী?’
মহিলা বলল, ‘আমার ছেলের নাম পলাশ।’
.
শীতের সন্ধ্যা, কুয়াশায় ঢাকা চারদিক। বারান্দায় বসে আছে ইফা। এখন আর কিছু ভাবছে না। ভাবতে-ভাবতে ক্লান্ত। ভাবনাগুলোর কোনও যুক্তি নেই। সে বাস্তবে যা দেখছে, তাতে বাস্তবতার কোনও চিহ্ন নেই। মনে যেসব প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, সেগুলোর কোনও জবাব নেই। যা কিছু এখন দৃশ্য, তা অদৃশ্য, আবার যা কিছু অদৃশ্য, তাই এখন দৃশ্য। বাস্তব আর অবাস্তবের মাঝে পাকিয়ে গেছে জট। যে পলাশকে চিনত, সে ছিল এই পৃথিবীর বাসিন্দা। কিন্তু সে এখন মৃত। এই পৃথিবী যে পলাশকে চিনত, সে মৃত। কিন্তু ইফার কাছে সে দৃশ্যমান। পলাশ কাছে এসেছে, ভালবেসেছে। কিন্তু সে তো মৃত! তা হলে?
ইফা ভাবছে, শুনেছি যারা আত্মহত্যা করে, অতৃপ্ত হয়ে পৃথিবীতে ঘোরে তাদের আত্মা। আত্মহত্যা করেছে পলাশও। ওর অতৃপ্ত আত্মা এল কেন আমার কাছে? এর সঙ্গে আমি জড়িত কীভাবে? পলাশ আত্মহত্যা করল কেন? সে আমাকে কখনও তার জীবন সম্পর্কে বলেনি। ও কি আসলেই কোনও অতৃপ্ত আত্মা? নাকি সবকিছু আমার দুঃস্বপ্ন?
কলিংবেলের আওয়াজে বাস্তবে ফিরল ইফা। দরজা খুলে দেখল দাঁড়িয়ে আছে জুয়েল। বাসায় ঢুকতে-ঢুকতে প্রশ্ন করল, ‘কেমন আছ? নিশ্চয়ই রাগ করে আছ আমার ওপর?’
ঘৃণায় শরীর ঘিনঘিন করে উঠল ইফার। কোনও জবাব দিল না।
কিন্তু এসব লক্ষ্য করল না জুয়েল। বলেই যাচ্ছে, ‘কী যে করব, বল? কাজের এতই চাপ, তোমাকে ঠিকমত ফোনও করতে পারিনি। জানি, সেজন্য তুমি রাগ করে আছ।’ কথাগুলো বলে ফ্রেশ হওয়ার জন্য বাথরুমে ঢুকল জুয়েল।
বিছানায় মাথা নিচু করে বসে আছে ইফা।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে ইফাকে খেয়াল করল জুয়েল। ওর পাশে গিয়ে বসল সে। হাত ধরতে চাইলে সরিয়ে নিল ইফা। খুব অবাক হয়ে জানতে চাইল জুয়েল, ‘ইফা, কী হয়েছে তোমার? কেন এমন করছ?’
‘তার আগে বল, তুমি এমন কেন করলে আমার সাথে?’ কান্না জড়ানো কণ্ঠে জানতে চাইল ইফা।
‘কী করলাম তোমার সাথে?’ জুয়েল উদ্বিগ্ন।
‘এই যে তুমি আমাকে একদম ভুলে গেলে?’
‘ওহ্, এ কথা?’ হাসতে-হাসতে ইফাকে জড়িয়ে ধরল জুয়েল।
এবার বাধা দিল না ইফা। তবে ঘৃণায় এল বমি।
জুয়েল আদর মাখানো কণ্ঠে বলল, ‘লক্ষ্মীসোনা, প্লিজ রাগ কোরো না। এই যে আমি এসে গেছি। আর কখনও তোমাকে ফেলে যাব না।’
‘হ্যাঁ, আর তোমাকে যেতে দেব না,’ বলল ইফা।
রাতে খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল ওরা।
মাথাব্যথার অজুহাত দেখিয়ে পাশ ফিরে শুয়েছে ইফা।
.
ইফার ঘুম ভাঙল রাত বারোটা ত্রিশ মিনিটে। নিঃশব্দে বিছানা থেকে উঠে পড়ল। দরজা খুলে সম্মোহিতের মত চলল ছাদে। আজ খোলা ছাদের দরজা। ইফা সোজা চলেছে পানির ট্যাংকের দিকে।
হ্যাঁ, প্রথম দিনের মতই আজও রেলিং-এ শুয়ে আছে পলাশ। ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াল ইফা।
এসো, ইফা, তোমার জন্য অপেক্ষায় ছিলাম।’ উঠে বসল পলাশ।
পলাশের নীল চোখ দেখল ইফা। অপূর্ব নীল চোখে হাজারো রহস্যের খেলা। পলাশের ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি। ইফার চোখেও হাজারো প্রশ্ন।
‘জানি, অনেক কিছু জানতে চাও। কিন্তু কিছুই বলতে পারছ না। তুমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এখন একটা দৃশ্য দেখবে তুমি। ওটা থেকে হয়তো পেতেও পার তোমার প্রশ্নের জবাব।’ ইফার চোখদুটো বন্ধ করে দিল পলাশ।
কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে ইফা দেখল, পলাশের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। দেখতে কেমন চেনা-চেনা লাগছে। হ্যাঁ, এবার ইফার মনে পড়ল: মেয়েটিকে সে দেখেছে গত রাতে একবার। মেয়েটির কী যেন নাম? কী যেন নাম? হ্যাঁ, মনে পড়েছে! মেয়েটিকে ডেইজি বলে ডেকেছিল জুয়েল। মেয়েটির পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে পলাশ। মেয়েটিকে দেখাচ্ছে অত্যন্ত শান্ত। কিন্তু খুবই অস্থির পলাশ। খুব আকুল হয়ে মেয়েটিকে প্রশ্ন করল: ‘কেন তুমি আমার সাথে প্রতারণা করলে?’
মেয়েটি বলল, ‘প্রতারণা? কে করেছে? এই আমি? অসম্ভব!’
‘এখনও মিথ্যা বলছ, ডেইজি, ছি! আমি কখনও কল্পনাও করিনি তোমাকে অন্য এক পুরুষের সাথে বিশ্রী অবস্থায় দেখব!’
‘দেখো, পলাশ, তুমি যাকে অন্য পুরুষ বলছ, সে আমার ভালবাসার মানুষ।’
‘তবে আমি কী? তবে কেন ভালবাসার অভিনয় করলে? বল, জবাব দাও!’ রাগী কণ্ঠে জানতে চাইল পলাশ।
ডেইজি হাসতে লাগল। সে হাসি যেন গায়ে আগুন ধরিয়ে দিল পলাশের। সামনে বেড়ে ডেইজির গলা টিপে ধরল ও। ‘তুমি আমার ব্যাঙ্কে যত টাকা-পয়সা ছিল, সব মিথ্যা কথা বলে হাতিয়ে নিয়েছ! তার চেয়েও বড় কষ্টের বিষয়, তুমি ভালবাসার অভিনয় করে ভেঙে দিয়েছ আমার মন! তুমি চুরমার করেছ আমার হৃদয়টা! আমি তোমাকে ছাড়ব না!’ জেদের সুরে বলছে পলাশ।