মুহূর্তে কেঁপে উঠল ইফা। যেন ওর মাথার ওপর ভেঙে পড়েছে সমস্ত পৃথিবীটা। বুকে অনুভব করল প্রচণ্ড ব্যথা। কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে বলল, ‘তুমি…তুমি…এসব কী বলছ? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’
খুব শান্ত কণ্ঠে পলাশ বলল, ‘ইফা, তুমি জানতে চাও আমি কে কিংবা কী। আমি বাস্তব না অবাস্তব। শুধু এটুকু বলব, তোমার পৃথিবী বড়ই রহস্যময়। বড়ই অদ্ভুত এক জায়গা। দৃশ্য-অদৃশ্যের মাঝে বা বাস্তব-অবাস্তবের মাঝে আছে একটা আজব তরঙ্গ, যা আমাদেরকে কমবেশি প্রবাহিত করে। হয়তো বা সেই তরঙ্গই তোমার আর আমার মাঝে সৃষ্টি করেছে ভালবাসার বন্ধন। জন্ম দিয়েছে রহস্যময় এক ভালবাসার। মনে হচ্ছে, তুমি কিছুই বুঝতে পারছ না। চল, আজ তোমাকে একটা দৃশ্য দেখাষ, যা ছিল আমার অনেক দিনের প্রত্যাশা।
ইফাকে আস্তে করে জড়িয়ে ধরল পলাশ। বাধা দিতে চাইল ইফা, কিন্তু পারল না। খুব কাছ থেকে পলাশের নীল চোখদুটো সম্মোহিত করে ওকে। আজও তা-ই হলো। ইফা ধীরে-ধীরে চোখ বন্ধ করে মাথা রাখল পলাশের বুকে। অনুভব করল, কোথায় যেন যাচ্ছে ভেসে-ভেসে।
এভাবে প্রায় মিনিট পাঁচেক যাওয়ার পর পলাশ বলল, ‘ইফা, চোখ খুলে দেখো জানালা দিয়ে তোমার দেখা সেরা দৃশ্য।’
ধীরে-ধীরে চোখ খুলল ইফা। দেখল অনেক নিচে রাস্তা। এখন ফাঁকা। তারা দাঁড়িয়ে আছে কোনও এক বিশাল বিল্ডিং-এর পাশে। ওটা সম্ভবত বড় কোনও হোটেল। সামনে একটা জানালা দেখতে পেল ইফা। তারা ভাসছে জানালার পাশেই।
জানালার একপাশের পর্দা সরানো। ইফা উঁকি দিতে দেখল, একটা বিছানা এবং একটু দূরে একটা বড় টিভি। টিভিতে সম্ভবত ইংলিশ কোনও সিনেমা চলছে। বিছানায় বসে আছে এক লোক। যদিও তাকে দেখছে সে পিছন থেকে, তবুও একটু ভাল করে দেখতেই চিনল লোকটা কে। সে অপরিচিত কেউ নয়। তার স্বামী জুয়েল। জুয়েলকে দেখতে পেয়ে খুশিতে চিৎকার করে ডাক দিল ইফা। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝল, ওর গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোচ্ছে না। হঠাৎ জুয়েলের পাশে এসে দাঁড়াল অপূর্ব সুন্দরী এক মেয়ে। পরনে কিছুই নেই। শুধু একটা তোয়ালে দিয়ে ঢেকে রেখেছে শরীর। মেয়েটি জুয়েলের সামনে দাঁড়িয়ে, তাই টিভি দেখতে পাচ্ছে না জুয়েল। মেয়েটিকে বলল, ‘জান, সরে দাঁড়াও। দেখতে পাচ্ছি না তো।’
মেয়েটি কিছুই বলল না। শুধু ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। জুয়েল আবারও বলল, ‘ডেইজি, লক্ষ্মী মেয়ে, সরে দাঁড়াও। ইন্টারেস্টিং জিনিসটাই দেখতে পাচ্ছি না।’
এবার মেয়েটি আদরমাখা মধুর কণ্ঠে বলল, ‘সিনেমাটি কি তোমার কাছে আমার চেয়েও ইন্টারেস্টিং?’
এ কথা শুনে দুষ্টু হেসে মেয়েটির তোয়ালে ধরে টান দিল জুয়েল।
তোয়ালে খুলে পড়তেই লজ্জায় জুয়েলের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েটি।
জুয়েলও মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল।
আর এ দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারাল ইফা।
.
ওর জ্ঞান ফিরল দুপুর বারোটায়। এতই দুর্বল, কিছুতেই উঠতে পারল না বিছানা ছেড়ে। খুব কষ্ট করে উঠে প্রথমেই খেল এক গ্লাস পানি। ওর মনে ছিল না কালকে রাতে কী দেখেছে। কিছুক্ষণ পর মনে পড়ল জুয়েলের কথা। ঘৃণায় ঘিনঘিন করে উঠল গা-টা। বিষিয়ে গেছে মন। ইফা সিদ্ধান্ত নিল, আত্মহত্যা করবে। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভাল। চোখ মুছতে-মুছতে ছাদে উঠবে বলে সিঁড়ি বেয়ে উঠল ইফা। কিন্তু ছাদের দরজায় ঝুলছে ইয়া বড় এক তালা। ওটার ওপর মাকড়সার জাল। দেখলে মনে হয় যেন বহুদিন ধরে এ তালা ঝুলছে।
কিন্তু …
‘কে তুমি, মা?’ হঠাৎ পিছন থেকে জানতে চাইল এক মহিলা।
সিঁড়িতে এক ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে, দেখল ইফা।
‘আমি ইফা। দশতলার ডানপাশের ফ্ল্যাটে থাকি।’
‘ও, আচ্ছা।’
‘দিনের বেলায় কি ছাদের দরজা বন্ধ থাকে, আণ্টি?’
মহিলাটি বলল, ‘হ্যাঁ। দিনে-রাতে সবসময় এ তালা বন্ধ থাকে। দেখছ না তালার কী দশা হয়েছে?’
এ কথা শুনে মাথা ঘুরে উঠল ইফার। পড়ে যাবে, এমন সময় এসে ধরল মহিলা।
তার বাসা বারোতলায়, নিয়ে গেল ইফাকে নিজের ফ্ল্যাটে। ঠাণ্ডা পানি খেতে দিল ওকে।
ঢকঢক করে পানি খেল ইফা। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘আণ্টি, ওই সময় আপনি কী যেন বলেছিলেন? ছাদের দরজা কি সবসময় বন্ধ থাকে?’
‘হ্যাঁ, আজ প্রায় এক বছর থেকে।’
‘কিন্তু…আমি যে…আচ্ছা, কেন বন্ধ থাকে?’
‘তুমি কি এখানে নতুন?’
‘জী, আমি এসেছি ছয় মাস হবে।’
‘ও, আচ্ছা, তার মানে ঘটনাটা তোমার জানা নেই?’
ইফা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ঘটনা? কীসের ঘটনা?’
‘ঘটনাটা আমার ছেলের, আমার একমাত্র ছেলের ঘটনা,’ এ কথা বলতে-বলতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল মহিলা। ‘প্রায় এক বছর আগের কথা। আমার একটি ছেলে ছিল। ও লেখাপড়া শেষ করে ব্যবসা শুরু করেছিল। পরিবার বলতে আমি, আমার এক ছেলে আর এক মেয়ে। আমার স্বামী মারা গেছেন অ্যাক্সিডেন্টে। কিন্তু আমরা কোনওরকম বিপদে পড়িনি। কারণ আমার স্বামী ব্যাঙ্কে রেখে যান অনেক টাকা। লেখাপড়া শেষে আমার ছেলে সেই টাকা দিয়ে শুরু করে ব্যবসা। এবং অল্প দিনের মধ্যে খুব উন্নতিও করে। যে পরিমাণ টাকা ছিল, তার তিনগুণ লাভ হলো। এরপর ভাবলাম এবার ছেলেকে বিয়ে দেয়া দরকার। বিয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই ছেলে খুব লজ্জার সঙ্গে বলল, একটি মেয়েকে খুব পছন্দ করে। তো বললাম মেয়েটিকে একদিন নিয়ে আসতে। কিছু দিন পর মেয়েটিকে নিয়ে এল। মেয়েটি ছিল খুব সুন্দরী। দেখলে মায়া হয়। বিয়ের কথা বলতে মেয়েটি বলল, এখন নয়, সে আরও কিছু দিন সময় চায়। তো মেনে নিলাম। এর কিছু দিন পর আমার ছেলেটা কেমন যেন বদলাতে লাগল। ঠিকমত খায় না, ঘুমায় না, সারাক্ষণ টেনশন করে। তারপর একদিন এল সেই ভয়ঙ্কর দিন, যা এখনও…’ বলতে গিয়ে কেঁদেই ফেলল মহিলা। ‘সেদিন ভোর পাঁচটায় বাসায় এল পুলিস। এসে আমার ছেলের নাম, আমার নাম জানার পর, আমাকে জানাল নিচে পড়ে আছে আমার ছেলের লাশ… এ কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল মহিলা।