ঘরের দরজায় তালা মেরে চাবিটা পানির বোতলে রেখে তা রাখল ফ্রিজে। সহজে মনে পড়বে না ওটার কথা।
.
রাত প্রায় বারোটা বেজে পাঁচ মিনিট
এসময় কিছু একটা পড়ে যাবার শব্দে ঘুমটা ভাঙল ইফার। উঠে বসল বিছানায়। বাইরের বাতির আলোতে ঘরটা পুরোপুরি অন্ধকার নয়। দেখল শোকেস থেকে পড়ে গেছে ফ্লাওয়ার ভাস।
উঠে ভাঙা টুকরো তুলতে গিয়ে শুনল বাতাসে দুলছে বারান্দার দরজাটা। ওটা দেখে খুব ভয় পেল ইফা। ঘুমানোর আগে ওই দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে শুয়েছে। তা হলে কীভাবে খুলল দরজা?
আজ শোবার ঘরে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। ইফা উঠে দরজাটা বন্ধ করবে, এমন সময় কে যেন বারান্দা থেকে ওকে ডাকল।
প্রচণ্ড ভয় পেল ইফা। খাড়া হয়ে গেল শরীরের সমস্ত রোম। কাঁপতে লাগল হাত-পা। অনেক কষ্ট করে সাহস জোগাড় করল ইফা, তারপর ভয়ে ভয়ে উঁকি দিল বারান্দায়। দেখল, পলাশ গ্রিল ছাড়া বারান্দার ওপ্রান্তে বসে আছে রেলিং-এ। খুব অবাক হলো ইফা এবং দ্বিগুণ বাড়ল ওর ভয়।
‘ইফা, ভয় পেয়েছেন?’
ইফা কাঁপতে-কাঁপতে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ।’
‘ভয় পাবেন না। আমি পলাশ, কাছে আসুন।’
ইফা বারান্দায় বেরোল, কিন্তু কাছে গেল না।
‘ইফা, আপনি ঘেমে যাচ্ছেন কেন? আজ ভীষণ কুয়াশা পড়েছে।’
ইফা টের পেল, সত্যি-সত্যি ঘেমে গেছে। ‘আপনি জানলেন কেমন করে যে আমি ঘেমে যাচ্ছি? আপনি তো বাইরে তাকিয়ে আছেন। আমার দিকে তো একবারও তাকাননি!’
‘অনেক কিছু না দেখেও বলে দেয়া যায়। আর অনেক কিছু বুঝে নিতে হয়।’
‘আমি সত্যি খুব অবাক হচ্ছি, আপনি এখানে এলেন কীভাবে? এ-ও কি সম্ভব?’
‘আকাশে ভেসে বেড়ানো যদি সম্ভব হয়, তা হলে এখানে আসাটা কি সম্ভব হতে পারে না?’
‘যা ঘটছে, তা কি আমার স্বপ্ন নাকি সত্যি?’
‘দেখুন, যা কিছু ঘটছে, তা হোক না স্বপ্ন কিংবা বাস্তব-এতে কী যায় আসে? যা ঘটছে ঘটতে দিন। হয়তো অনেক কিছু দেখবেন, হয়তো অনেক কিছু পাবেন কিংবা অনেক কিছু হারাবেন।’
ওর দিকে চাইল পলাশ।
ইফা দেখল নীল চোখদুটো কী সুন্দর, কী অপূর্ব! চঞ্চল করে মনকে। মনে হয়, কী যেন বুঝতে চাচ্ছে ওই নীল চোখদুটো। কিংবা কী যেন বুঝে নিচ্ছে! কী যেন বিনিময় করছে নীরব ভাষায়!
পলাশ তার নীল দু’চোখ দিয়ে ওকে সম্মোহন করছে মনে হলো ইফার। ধীরে-ধীরে ওর পরিচিত জগৎকে ভুলে অজানা এক নতুন জগতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ও।
‘ইফা, ইফা…’
‘হুঁ?’
‘এখনও কি ভয় পাচ্ছেন আমাকে?’
‘না।’
‘কাছে আসুন, ইফা।’
সম্মোহিতের মত পলাশের কাছে গেল ইফা।
‘ইফা, আপনার কেমন লাগছে?’
‘জানি না। আচ্ছা, আপনি কি সত্যি ম্যাজিশিয়ান?’
‘সম্ভবত।’
‘আপনি কি পারবেন আমার মনের দুঃখ দূর করে দিতে কিংবা ভুলিয়ে দিতে?’
‘আপনি তো এখনি অনেক দুঃখ থেকে দূরে সরে গেছেন। জানি, ইফা, আপনার মনে অনেক দুঃখ, অনেক কষ্ট এবং এ-ও জানি, আপনার দুঃখটা কীসের। আপনি আমার আরও কাছে আসুন, আমি আপনার দুঃখ ভুলিয়ে দেব।’
ইফার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়েছে পলাশ। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না ইফা। পলাশকে জড়িয়ে ধরল, পলাশও জড়িয়ে ধরেছে ইফাকে।
ইফা উপলব্ধি করছে, অনেকখানি কমে গেছে মনের দুঃখের ভার। অস্থির দেহ-মনে এল পরম এক শান্তি। যেন এই শান্তি খুঁজে বেড়াচ্ছিল বহুকাল থেকে।
.
কিছুক্ষণ পর…
‘পলাশ, তুমি স্বপ্ন হয়ে আমার কাছ থেকে চলে যাবে না তো?’
‘না।’
‘তুমি কি…তুমি কি আমাকে…. ভালবাস?’
‘হ্যাঁ।’
ইফা দেখল, ওর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে পলাশ। নীল অপূর্ব চোখদুটিতে ভালবাসা ও আবদার। চোখ বন্ধ করে নিজেকে পলাশের কাছে সঁপে দিল ইফা।
পলাশ বুঝে নিল ভালবাসায় সাড়া দিচ্ছে ইফা। ওকে কোলে তুলে নিল পলাশ।
ইফা অনুভব করল, ভেসে-ভেসে ওকে নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে পলাশ। এই অনুভব শেষ হতে না হতেই বিছানা স্পর্শ করল ওর শরীর। নিচে নরম তুলতুলে বিছানা ও শরীরের ওপরে পলাশের ঠাণ্ডা শরীরটাকে টের পেল ইফা।
.
সকালে উঠে গত রাতে কী ঘটে গেছে, বুঝতে পারল ইফা। সব মনে পড়তেই ইচ্ছা করল লজ্জায়, অপমানে আত্মহত্যা করতে। ভাবল, আমি তো প্রতারণা করেছি আমার স্বামীর সঙ্গে। অথচ ও আমাকে কত ভালবাসে, বিশ্বাস করে। না হয় সে আমাকে সময় দিতে পারে না, তাই বলে কি আমি তার বিশ্বাস ভঙ্গ করব? আমি কেন নিজেকে এভাবে সঁপে দিলাম? কেন নিজের সম্মান রক্ষা করতে পারলাম না? কেন? কেন? কেন?
সারাদিন কিছু না খাওয়াতে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ল ইফা। লাইট নিভিয়ে শুয়ে আছে পলাশের অপেক্ষায়। হঠাৎ দমকা বাতাসে খুলে গেল বারান্দার দরজা। টেবিল থেকে পড়ে ভাঙল পানির গ্লাসটা। ইফা দেখল, দরজায় দাঁড়িয়ে আছে পলাশ। ভালবাসার তৃপ্তি ও রহস্যময় অদ্ভুত কিছু খেলা করছে তার অপূর্ব নীল চোখে।
‘ইফা, তোমাকে আজ এমন দেখাচ্ছে কেন? তুমি কি অসুস্থ?’
কোনও জবাব দিল না ইফা। কাঁদছে মাথা নিচু করে।
এগিয়ে এল পলাশ।
‘তুমি কে? কেন তুমি স্বপ্নের মত শুধু রাতে আসো? তুমি কী? বাস্তব না অবাস্তব?’
‘তুমি কি দুঃখ পেয়েছ? আমি কি এমন কিছু করেছি, যাতে তোমার দুঃখ, লজ্জা, অপমান হওয়া উচিত? আমার মনে হয় তুমি তেমন কিছুই করোনি।’
‘মানে! কী বলতে চাও তুমি?’
‘আমি শুধু এটুকু বলতে চাই, যে অপরাধ জুয়েল তোমার সঙ্গে দিনের পর দিন অহরহ করে যাচ্ছে, তা কেবল একবারই করেছ তুমি। যেটাকে আমার মতে অপরাধ বলা যাবে না।’