‘অনেকটা তা-ই বলতে পারেন,’ এ কথা বলে রেলিং-এ উঠে বসল যুবক। ‘দূরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন, কাছে আসুন। আপনার সাথে একটু কথা বলি। আচ্ছা, আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন?’
‘সম্ভবত।’
‘কেন?’
‘আমার মনে হচ্ছে আপনি অদ্ভুত টাইপের মানুষ। রেলিং-এ শুয়ে থাকেন, তা-ও আবার নিশ্চিন্ত মনে। কারও আসার খবর পান, তা-ও আবার আকাশের তারা দেখে।’
এ কথা শুনে হেসে ফেলল যুবক। ‘কাছে আসতে পারেন। কোনও ভয় নেই।’
ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেল ইফা। ‘আপনি কে?’
‘আমি? আমি…হয়তো আপনার, কাছের কেউ, কিংবা হয়তো কেউ ছিলাম না।’
‘মানে?’
‘মানে তো বুঝবেন না। আমাকে পলাশ বলে ডাকতে পারেন।’
‘কী করেন আপনি?’
‘যখন মন যা চায়, তা-ই খুঁজে বেড়াই।’
‘আপনি খুব জটিল কথা বলেন। আচ্ছা, আপনি কি প্রতি রাতে এখানে আসেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন আসেন?’
‘বন্ধুদের সাথে মনের দুঃখ শেয়ার করতে।’
‘বন্ধু? কোথায় আপনার বন্ধুরা?’
‘এই যে তারা ভরা রাতের আকাশ, খোলা বাতাস, নির্জন রাত-এরাই তো বন্ধু। তা-ই তো ভাল।’
‘আচ্ছা, আপনার দুঃখটা কী?’
‘সরি, এটা পার্সোনাল সাবজেক্ট।’
‘আকাশ, বাতাস, নির্জন রাত-এদের সাথে দুঃখ শেয়ার করলে তারা কি বোঝে?’
‘হ্যাঁ, খুব ভালই বোঝে। জানেন, ইফা, একটা মানুষের দুঃখ একটা মানুষের চাইতে প্রকৃতিই ভাল বুঝতে পারে।’
‘আচ্ছা, আপনি কী করে জানলেন আমার নাম ইফা?’
‘ওই যে বললাম, সম্ভবত আমি ম্যাজিশিয়ান।’
‘হাউ ইন্টারেস্টিং! আপনি আর কী-কী জানেন কিংবা কী-কী পারেন?’
‘বলুন এখন আপনার কী মনে হচ্ছে?’
‘আপনি তো ম্যাজিশিয়ান, আপনিই বলুন দেখি?’
‘আপনার এখন মন চাচ্ছে…’ চুপ হয়ে গেল যুবক। ‘হ্যাঁ, বলুন আমার মন এখন কী চাচ্ছে?’
‘আপনার মন চাচ্ছে…আকাশে উড়তে।’
রীতিমত অবাক হয়ে গেল ইফা। বলল, ‘আপনি কী করে বলতে পারলেন? আপনি সত্যি-সত্যি বলেছেন। পারলেন কী করে? আপনি সত্যি আমাকে আকাশে ওড়াতে পারবেন?’
‘হ্যাঁ, না পারার কী আছে?’
‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’
‘ঠিক আছে, চলুন, আপনাকে নিয়ে ঘুরে আসি।’
‘আপনি ফান করছেন।
‘আপনি এসে হাত ধরেই দেখুন না।’
‘না, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’
পলাশ এগিয়ে যেতেই দু’পা পিছিয়ে গেল ইফা।
‘আরে, পিছিয়ে যাচ্ছেন কেন?’
‘আমার ভয় করছে।
‘ভয়ের কিছু নেই। আমার হাতটা ধরুন।’
ইতস্তত করতে লাগল ইফা।
‘কী হলো, ধরুন আমার হাত।’
খুব সংকোচের পর হাতটা ধরল ইফা।
ইফাকে নিজের কাছে টেনে নিল পলাশ। পিছনে দাঁড়িয়ে নিজের দু’হাতে ধরল ইফার দু’হাত। ‘এবার চোখ বন্ধ করুন,’ ফিসফিস করে বলল ইফার কানে।
কিছু বলতে গিয়েও বলল না ইফা। ভয়ে-ভয়ে চোখ বন্ধ করল। দুই সেকেণ্ড পর অনুভব করল, পায়ের নিচ থেকে যেন সরে গেল ছাত। পায়ের নিচে এখন কিছুই নেই! চোখ খুলতে গিয়েও ভয়ে খুলতে পারল না ইফা। নিজেকে কেমন যেন ওজনশূন্য লাগছে। চোখ বন্ধ করেই বুঝতে পারছে, ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে।
‘ইফা?’
‘হুঁ?’
‘কেমন লাগছে?’
‘জানি না।’
‘চোখ খুলুন।
‘ভয় লাগছে।’
‘ভয় পাবেন না। আমি আছি আপনার সাথে। এই মুহূর্তে আমি আপনার সবচেয়ে আপন।
ধীরে-ধীরে চোখ খুলল ইফা। যা দেখল, সত্যিই অবাক হলো। অনেক নিচে কুয়াশার স্তর এবং তারও অনেক নিচে ঘুমন্ত পৃথিবী! ওপরে আকাশের তারা অনেক কাছে। যেন আরেকটু উঠলে ছুঁয়ে দিতে পারবে হাত দিয়ে। আজ আকাশে কোনও চাঁদ নেই।
‘ইফা, কেমন লাগছে?’ ফিসফিস করে জানতে চাইল পলাশ।
‘ভয় লাগছে, যদি পড়ে যাই।’
এ কথা শুনে ইফাকে জড়িয়ে ধরল পলাশ। ‘এখন কেমন লাগছে? পড়ে যাবার ভয় পাচ্ছেন?’
‘না। আশ্চর্য রকম ভাল লাগছে।
‘কী মনে হচ্ছে এখন নিজেকে? ‘
‘মনে হচ্ছে পাখির মত স্বাধীন, যার মনে কোনও দুঃখ নেই। যার জীবনে কোনও বাধা নেই। পলাশ, নিজেকে মুক্ত মনে হচ্ছে আমার।’
‘চলুন, এখান থেকে আমরা চলে যাই।’
চোখ বন্ধ করল ইফা। নেমে আসছে আস্তে-আস্তে। কতক্ষণ লাগল জানে না, যখন চোখ খুলল, দেখল ওকে জড়িয়ে ধরে রেলিং-এ বসে আছে পলাশ।
নিজেকে ছাড়াতে গিয়েও পারল না ইফা। কিছু বলতেও পারল না। যেন ও-ও চাইছে ওকে ধরে রাখুক পলাশ। চাইল অসহায়ের মত পলাশের দিকে।
চোখ বন্ধ করে আছে পলাশ। ধীরে খুলল চোখের পাতা। ঝিকঝিক করছে নীল মণি।
.
সকালে নাস্তা খেতে-খেতে হঠাৎ গত রাতের কথা মনে পড়ল ইফার। আবারও পড়ে গেল দ্বিধার মধ্যে। একবার মনে হয় স্বপ্ন, কিন্তু এত বাস্তব লাগে, স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। আর ওসব সত্যি ভাবতে গেলেই শিউরে ওঠে গা। আকাশে উড়ে বেড়ানো কী করে সম্ভব?
যাই, দিনের বেলায় গিয়ে দেখে আসি ছাদটা আসলে দেখতে কেমন, ভাবল ইফা। ছাদে যাবে এমন সময় বেজে উঠল মোবাইলটা।
জুয়েলের ফোন।
‘হ্যালো?’
‘হ্যালো, ইফা; কেমন আছ?’
‘ভাল। তুমি কেমন আছ?’
‘ভাল। তোমার কোনও প্রবলেম হচ্ছে না তো?’
‘না, তবে খুব বেশি একা লাগে।’
‘আর ক’টা দিন ধৈর্য ধরো, তারপর তো আমি চলে আসছি।’
‘আর ক’টা দিন মানে? তুমি দু’দিনের মধ্যে আসতে পারবে না?’
‘অবশ্যই আমি চেষ্টা করব। তোমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো?’
‘না, অসুবিধে হচ্ছে না। ‘
‘আচ্ছা, আমি তা হলে এখন রাখি।’
‘তুমি ভাল হয়ে থেকো কেমন?’
‘আচ্ছা।’
সারাদিন জুয়েলের কথা ভেবে কাটল ইফার। কিন্তু রাতে শোবার আগে মনে পড়ল পলাশের কথা। ভয়ে বুক দুরুদুরু কাঁপতে লাগল ওর। ভাবল, নাহ্, আজ বুঝতেই হবে, যা কিছু ঘটছে, তা স্বপ্ন না সত্যি!