রাত সোয়া দশটা বেজে যায়। সুমন ঘুমিয়ে পড়ে। তুমুল ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়। বাইরেটা যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে চায়। ইলেকট্রিসিটি চলে যায়। কিন্তু তখনও সুমনের বাবার দেখা নেই।
সুলতানা বেগম অস্থির হয়ে ওঠেন। ভেবে পান না কী করবেন। আজকালকার মত তখনকার দিনে সবার পকেটে- পকেটে মোবাইল ফোন ছিল না। কী করে সুমনের বাবার খোঁজ নেবেন? সুমনের বাবার অফিসে ফোন ছিল। কিন্তু সেই ঝড়-বৃষ্টির রাতে কোথা থেকে ফোন করবেন? অবশ্য বাড়িওয়ালার বাসায় ফোন ছিল। ভাবেন, বাড়িওয়ালার কাছে গিয়ে একটা ফোন করার জন্য অনুরোধ করবেন। আবার এ-ও ভাবেন, হাড়কিপটে বাড়িওয়ালা কি ফোন করতে দেবেন?
ছলছল চোখে সুলতানা বেগম গিয়ে বাড়িওয়ালাকে একটা ফোন করার জন্য অনুরোধ জানান। কোনও উচ্চবাচ্য না করে বাড়িওয়ালা রাজি হয়ে যান। সুলতানা বেগমের হাতে রিসিভার ধরিয়ে দিয়ে নিজেই ডায়াল ঘুরিয়ে নাম্বার লাগিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে থাকেন।
মাঝবয়সী বাড়িওয়ালার মনে বোধহয় অন্য কিছু কাজ করছিল। সুলতানা বেগমের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ডায়াল ঘুরাতে-ঘুরাতে বার-বার হাতের কনুই সুলতানা বেগমের গায়ে ছুঁইয়ে দিচ্ছিলেন।
বেশ কয়েকবার ফোন করলেন। রিং হয়, কিন্তু কেউ রিসিভার তোলে না। অত রাতে অফিসের ফোনের রিসিভার কারও তোলার কথাও নয়। সুলতানা বেগমের চোখের কোনা বেয়ে পানি নামতে শুরু করে।
বাড়িওয়ালা সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে সুলতানা বেগমের কাঁধে হাত রাখেন। কাঁধে-পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলতে থাকেন, ‘ঝড়-বৃষ্টির রাত। পুরুষ লোকের মন বলে কথা। এমন একটা রাতও কি রোজকার মত নিজের ঘরে স্ত্রীর সঙ্গে কাটাতে ইচ্ছে করে? ঘর কা মুরগা ডাল বরাবর। গিয়ে দেখেন কোনও আবাসিক হোটেলের রুমে বসে কচি মুরগির রান চিবাচ্ছে। ভাবীজান, আপনি চিন্তা না করে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। দেখবেন, সকাল-সকাল ঠিকই চোখ জোড়া লাল করে ফিরে আসবে।’ গলার স্বর একটু নামিয়ে, ‘ভাবীজান, ঝড়-বৃষ্টির অন্ধকার রাত, একলা-একলা ভয় লাগলে বলেন-আমি গিয়ে আপনাকে পাহারা দিই। আমি থাকতে আপনার আবার কীসের ভয়!’
সুলতানা বেগমের চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছিল। তার মধ্যেই তিনি কী করে যেন কড়া গলায় বলে ওঠেন, ‘চাচাজান, আমার স্বামী আপনার মত খাটাস নয় যে, হোটেলে বসে কচি মুরগির রান চিবুবে।’ বলেই গট-গট করে চলে আসার সময় বিড়-বিড় করেন, ‘বুড়া খাটাসটার শখ কত, মুরগি পাহারা দিতে চায়!’
সেই রাতটা যে কীভাবে কাটছিল সুলতানা বেগমের! সারা রাত কেঁদে-কেঁদে বালিশ ভেজান। তিনটার পর ঝড়- বৃষ্টি থামে। ঝড়-বৃষ্টি থামলেও ইলেকট্রিসিটি আসে না। আসেন না সুমনের বাবাও। তখনও তিনি অপেক্ষায় থাকেন, এই বুঝি সুমনের বাবা এসে দরজায় নক করবেন।
অবশ্য কিছুক্ষণ পর-পরই দরজায় নক হচ্ছিল। বাড়িওয়ালা দরজা ধাক্কাধাক্কি করে জিজ্ঞেস করছিলেন, ‘ভাবীজান, ভাই কি এসেছেন? ভয় লাগলে বলেন, ভয় দূর করে দিই। আহারে! কী সুন্দর টসটসে চেহারার বউডারে ঘরে একলা ফেলে বাইরে রাত কাটায়! পুরুষ লোকের চরিত্র বলে কিছু নাই। ভাবীজানের উচিত একটা কঠিন শিক্ষা দেয়া। সে যদি বাইরে বসে মোরগ-পোলাও খেতে পারে, ঘরের ঘিতে আগুন লাগলে দোষ কী!’
সকাল হয়ে যায়। সুমনের বাবার কোনও খোঁজ নেই। বেলা বাড়তে থাকে। অফিসে, আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি, বন্ধু- বান্ধবদের বাড়ি, সব জায়গায় খোঁজ নেয়া হয়। কোথাও সুমনের বাবা নেই। শেষতক বিকেল নাগাদ থানায় মিসিং ডায়েরি করা হয়। সেই সঙ্গে সবক’টা হসপিটাল-ক্লিনিক সহ আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামেও খোঁজ নেয়া হয়। কোথাও সুমনের বাবা নেই। লোকটা যেন একেবারে গায়েব হয়ে গেছেন। না হলে কেউ তাঁকে গুম করেছে।
দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘুরে বছর আসে। একে-একে বাইশটা বছর চলে গেল। ছয় বছরের সুমন এখন আটাশ বছরের। কিন্তু সুমনের বাবা আর ফিরে এলেন না!
সুলতানা বেগম এখনও অপেক্ষায় আছেন। নিশ্চয়ই কোনও এক দিন তিনি ফিরে আসবেন। দরজায় নক করে ডাকবেন, ‘সুলতানা, ও, সুলতানা, দরজাটা খোলো। সুমন, বাবা, সুমন, তোর মাকে দরজাটা খুলতে বল।’
সুলতানা বেগম অপেক্ষায় আছেন সেদিন আবার তিনি রোস্ট, পোলাও আর ভুনা গরুর মাংস রান্না করবেন। গত বাইশ বছরে এই খাবারগুলো তিনি আর মুখে দেননি।
দুই
শেষ পর্যন্ত শাহজাহান ঘটক সুলতানা বেগমের পছন্দসই মেয়ের খোঁজ বের করতে পেরেছে।
মেয়ের নাম ঈশিতা। সমাজ বিজ্ঞানে অনার্স পড়ছে। একমাত্র মেয়ে। শহরতলিতে নিজেদের বাড়ি। বাবা নেই। মা-মেয়ের ছোট্ট সংসার।
ঈশিতার চেহারা অসম্ভব রকমের সুন্দর। মাখনের মত ফর্সা মোলায়েম গায়ের রঙ। গোলগাল আদুরে মুখ। উঁচু নাক। ভাসা-ভাসা বড় চোখ। ঘন আঁখি পল্লব। সবুজাভ চোখের মণি। দিঘল রেশমি চুল। সব সময় বাইরে বেরোয় বোরখা পরে। মুখ ঢাকা থাকে নেকাব দিয়ে। হাতে-পায়েও মোজা পরে। শুধু তার নিষ্পাপ চোখ দুটো বাইরে থেকে দেখা যায়।
অবশ্য ঈশিতাকে সামনা-সামনি দেখা হয়নি। শাহজাহান ঘটক ফটো এনে দেখিয়ে এসব বর্ণনা দিয়েছে। ফটো দেখে শাহজাহান ঘটকের বর্ণনা সঠিক বলেই মনে হয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফটোর চেহারার সঙ্গে সত্যিকারের চেহারার অনেক অমিল দেখা যায়। আর ঘটকরা যে হরহামেশাই নয়-ছয় কথা বলে তা-ও সবার জানা।