‘যাও, ফ্রেশ হয়ে এসো, নাস্তা দিচ্ছি।’
নাস্তা খেতে বসে জুয়েল বলল, ‘ওহো, তোমাকে তো একটা কথা বলাই হয়নি।’
‘কী কথা?’
‘আজ রাতে ঢাকার বাইরে যাচ্ছি।’
এ কথা শুনে দু’চোখ বেয়ে অশ্রু নামল ইফার।
‘আরে, তুমি কাঁদছ নাকি!’
‘কই, না তো!’ ইফা তাড়াতাড়ি মুছে ফেলল চোখের পানি। ‘কেন যাচ্ছ? ব্যবসার কাজে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কোথায়?’
‘চিটাগাং-এ, সেখানে কিছু কাজ চলছে, সেগুলো দেখতে হবে।’
‘কাদের কাজ?’
‘কাল যাদের সাথে পরিচয় হলো।’
‘ক’দিন লাগবে?’
‘এই ধরো, তিন-চার দিন।’
‘ঠিক আছে, তোমার ব্যাগ গুছিয়ে দেব।’
.
ইফা গুছিয়ে দিল স্বামীর ব্যাগ, মনটা খারাপ। কিন্তু রাত নয়টায় যখন জুয়েল চলে গেল, আর পারল না মনটাকে সামলে নিতে। কান্নায় ভেঙে পড়ল ও। একসময় ঘুমিয়ে গেল কাঁদতে-কাঁদতে।
হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভাঙল ইফার।
ঘড়িতে রাত সাড়ে বারোটা।
অস্বস্তি লাগছে ইফার। চারপাশ কেমন নিস্তব্ধ, নিশ্চুপ। ঘরটাতে যেন বহু দিনের ভাপসা, গুমট একটা ভাব। দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইল ওর। মনে হলো, খোলা জায়গায় যেতে না পারলে এক্ষুণি মারা পড়বে। ঘরটাতে যেন অক্সিজেনের অভাব। কিন্তু এত রাতে কোথায় যাবে? তা ছাড়া জুয়েলও তো নেই!
হঠাৎই মনে হলো যেতে পারে ছাদে।
কিন্তু এই অন্ধকারে কি যাওয়া সম্ভব?
তা ছাড়া, ও এর আগে কখনওই ছাদে যায়নি।
আরও বাড়তে লাগল ইফার অস্বস্তি। খুব অস্বাভাবিক লাগছে সবকিছু।
নাহ্! আর থাকা যায় না গুমট ঘরে।
বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে বেরিয়ে এল ইফা। এত রাতেও জ্বলছে সিঁড়ির লাইট। একা-একা ছাদে যেতে একটুও সমস্যা হলো না। পুরোপুরি অন্ধকার নয় ছাদ। মোটামুটি দেখা যাচ্ছে সবকিছুই। ছাদে এসে কমল অস্বস্তির ভাবটা। ফুরফুরে বাতাসে হালকা হলো মন। রেলিং-এর পাশে দাঁড়িয়ে দেখল শহরটাকে। এখন কোনও ব্যস্ততা নেই। মনে পড়ল জুয়েলের কথা। আনমনে স্বামীর কথা ভাবতে-ভাবতে চলে এল ছাদের আরেক প্রান্তে। এখানে সারিবদ্ধভাবে আছে অনেকগুলো পানির ট্যাংক। ইফা ঘুরে আরেক দিকে যাবে, এমন সময় দেখল দুই ট্যাংকের ফাঁকে সাদা কী যেন। আরেকটু কাছে যেতেই দেখল, নীল জিন্স প্যান্ট এবং সাদা ফতুয়া পরে রেলিঙে শুয়ে আছে একটা ছেলে।
ইফা ভাবল, চলে যাওয়া উচিত, কিন্তু এমন এক জায়গায় শুয়ে আছে ছেলেটা, যে-কোনও মুহূর্তে অ্যাকসিডেন্ট হবে। তাই এগিয়ে গেল ও। ‘এই যে, শুনছ?’
নারীকণ্ঠ শুনে ইফার দিকে চাইল ছেলেটা।
ইফা দেখল, সে বাচ্চা ছেলে নয়। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের যুবক।
একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবারও আকাশে নিষ্পলক চেয়ে রইল।
ইফা দেখল, যুবকটির চোখের মণি নীল রঙের। আগের চেয়ে জোরে বলল ইফা, ‘এই যে, আমি তোমাকে বলছি তুমি কি শুনতে পাও না?
‘জী, ভালভাবেই শুনতে পাই। আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেন? আমি তো আপনার পরিচিত কেউ নই।
‘তাতে কী? পরিচিত হব। আর তুমি করে বলেছি, কারণ ভেবেছি আপনি আমার থেকে ছোট। রেলিং-এর ওপর শুয়ে আছেন কেন? আপনার ভয় করছে না?’
‘না। বরং ভালই লাগছে।’
ইফা চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল। এক পা বাড়াতেই পিছন থেকে যুবকটি বলল, ‘চলে যাচ্ছেন?’
রেলিং-এর ওপর উঠে বসেছে যুবকটি। ইফা বলল,
‘হ্যাঁ। কেন?’
এখানে ভাল লাগছে না?’
‘নাহ্।’
‘আকাশ ভাল লাগছে না?’
‘না।’
‘খোলামেলা এই মুক্ত বাতাস ভাল লাগছে না?’
‘না।’
‘আমাকে ভাল লাগছে না?’
‘আশ্চর্য, আপনি এত প্রশ্ন করেন কেন?’
‘আপনি যে এত প্রশ্ন করছিলেন, আমি কি তখন এত
প্রশ্ন করেছি?’
‘এত প্রশ্ন করেন কেন? আপনি কে?’
‘আবারও প্রশ্ন করছেন?’ হাসল যুবক। এ কথা শুনে হেসে ফেলল ইফা।
.
সকাল আটটা।
প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙল ইফার। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর মনে পড়ল গতকাল রাতের ঘটনা। বুঝল না ওটা সত্য না স্বপ্ন। সারাদিন নিজেকে ব্যস্ত রাখাল ইফা। কিন্তু গতকাল রাতের ঘটনাটা দ্বিধায় ফেলেছে ওকে। মনে জমছে হাজারো প্রশ্ন। সব প্রশ্নের শেষ প্রশ্ন হলো, সত্য না স্বপ্ন?
রাত বারোটায় আপনা-আপনি ভাঙল ইফার ঘুম। বিছানায় বসে অস্বস্তিতে ভুগতে লাগল। আবারও গতকাল রাতের মতই মনে হলো, ঘরটা বড় গুমট। লাগছে ভাপসা গরম। বন্ধ হয়ে আসছে দম। শ্বাস নিতে পারছে না। ঘেমে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। একটু ঠাণ্ডা বাতাসের জন্য বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় গেল ইফা। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হলো না। দেখল বাইরে ভারী কুয়াশা, তবুও লাগছে গরম। কিছুক্ষণ বারান্দায় থাকার পর বুঝল, এখানে থাকলে স্রেফ দম বন্ধ হয়ে মরবে ও। তাই তাড়াতাড়ি রওনা দিল সিঁড়ির উদ্দেশে।
ছাদে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পর কমে গেল ইফার অস্বস্তি। কিছুক্ষণ পর ফিরবে, এমন সময় মনে হলো, যা-ই গিয়ে দেখি সেই যুবক আজকেও ওখানে আছে কি না!
হ্যাঁ, আছে। আগের রাতের মতই শুয়ে আছে রেলিং-এ। ইফা চুপচাপ চলে যাচ্ছিল, পিছন থেকে যুবকটি বলল, ‘চলে যাচ্ছেন নাকি?’
চমকে উঠল ইফা। ‘আপনি কীভাবে জানলেন আমি এসেছি?’
‘আকাশের তারা দেখে।’
‘মানে?’
‘মানে, এখন আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, ঠিক তার ওপরের তারাটিতে আপনার ছায়া পড়েছে।’
ইফা একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কি পাগল?’
‘পাগল হতে যাব কেন? পাগলের কি এই ক্ষমতা থাকে?’
‘তা হলে কী? ম্যাজিশিয়ান?’