কয়েক মুহূর্ত পর উঠে দাঁড়াল বাঘের পিঠে সওয়ার থাকা সেই বিভীষিকাময় জিনিসটা।
হ্যাঁ, মানুষই ওটা। আবার মানুষও নয়! ওটার দিকে তাকিয়ে একটু আগে বাঘের কবলে পড়ার চেয়েও অনেক বেশি অসহায় বোধ করল নুরু। কাঁপা কাঁপা হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল গলা থেকে বুকে ঝুলন্ত শিঙ্গাটা।
কেউ এখনও আসছে না কেন?
উত্তরটা জানা থাকলেও ওর উত্তপ্ত, ভীত মস্তিষ্ক বিষয়টা অস্বীকার করছে। মনে আশা, ঠিক যেভাবে খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায় ডুবন্ত মানুষ!
.
ঠোঁট চাটল মনসা তান্ত্রিক। ল্যাঠা চুকে গেছে। বিরাট এক বাঘ মেরেছে সে। আজ অনেক দিন পর পেট ভরে খাওয়া যাবে। খাবার নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না আগামী বেশ কিছু দিন। তবে একটা কাজ বাকি আছে। উপদেবতার মন পাওয়ার জন্য তুলা রাশির জাতকের একটা খুলি দরকার তার। লোকালয়ে হানা দিয়ে মানুষ শিকার করাটাকে নীতিগতভাবে ঘৃণা করে বলে এত দিনেও জোগাড় হয়নি জিনিসটা। গোটা দুই ডাকাত আর এক ভবঘুরে অবশ্য তার কবলে পড়েছিল। কিন্তু তাদের কারওই রাশি ঠিক ছিল না।
এই ছেলে কী রাশির, কে জানে!
একটাই উপায় আছে। দেবতার কাছে নৈবেদ্য দিতে হবে খুলিটা। সে অভিশাপ তুলে নিলে বুঝবে রাশি ঠিক ছিল। কোমর থেকে ভোজালিটা টেনে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে গেল সে ভূপাতিত নুরুকে লক্ষ্য করে।
.
বাড়ি ফেরার পথে রহিম সরদার আর তার দলের লোকেরা শুনল, বহুদূরে বাজছে শিঙ্গা।
একবার, দু’বার, তিনবার, চারবার…
নীল চোখের রহস্য – নূরুন নিসা মুন্নি
শীতের সন্ধ্যা, চারদিকে নামছে অন্ধকার। দূর দিগন্তে শেষ আলোর রেশটুকু মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশার মাঝে। প্রকৃতির এই পরিবর্তন বা সৌন্দর্য দেখার মত সময় ঢাকা শহরের ব্যস্ত মানুষের নেই। ইফা দশতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতি এবং শহর দেখে সময় কাটাচ্ছে। ওর একা-একা ভাল লাগে না, তাই সবসময় পছন্দ করে হইচই করতে। কিন্তু কার সঙ্গে হইচই করবে? তাকে সময় দেবার মত কেউ তো নেই! সারাদিন থাকে বাসায় একা। সময় কাটাতে হয় শুয়ে-বসে। বেশিরভাগ সময় কেটে যায় অতীত ভেবে। বাবা-মায়ের আদরের মেয়ে, ভাই-ভাবী, ছোট বোন অন্তু, পুকুর ঘাট, টিনের বাড়ি, উঠানের ফুলগাছ, আরও কত কিছু! কিন্তু এখন, বিয়ের পরে, উঁচু বিল্ডিং-এ ফ্ল্যাট, একাকী সংসার, মস্ত শহর, ব্যস্ত মানুষজন আর ব্যস্ত একজন স্বামী। জুয়েলের সঙ্গে ইফার বিয়ে হয়েছে ছয় মাস আগে। যেদিন বিয়ে হলো, তার পরদিনই ওরা চলে এসেছে ঢাকা শহরে। সেই থেকে ইফার একাকীত্ব শুরু…
জুয়েল খুব করিৎকর্মা মানুষ, পেশা ব্যবসা আর নেশা হলো টাকা রোজগার করা। সবসময় নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে পড়ে আছে। তাই ইফাও সুযোগ পায় না স্বামীর সঙ্গে গল্প করতে। এভাবেই দূরে রয়ে গেছে ওরা, চেনা আর হয়ে ওঠেনি একজন আরেকজনকে। জুয়েলের কথা মনে হতেই ইফা ভাবল, ওকে একবার কল করি।
দেরি হলো না মোবাইল ফোনে কল দিতে।
একবার, দুইবার, তিনবারেও কল রিসিভ করল না জুয়েল।
তার দশ মিনিট পর কল এল ইফার মোবাইলে।
‘হ্যালো!’
‘হ্যালো, হ্যাঁ, কল করেছিলে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন? কোনও প্রবলেম?’
‘না।’
‘তা হলে?’
‘এমনিতেই কল করেছি।’
‘ও, আচ্ছা। আমি এখন একটু ব্যস্ত, পরে…’
‘তুমি কখন আসবে?’
‘ঠিক নেই, তুমি খেয়ে নিয়ো।’
‘আচ্ছা।’
‘ঠিক আছে, রাখি।’
স্বামী-স্ত্রীর কথা শেষ।
মন আরও বেশি খারাপ হয়ে গেল ইফার।
.
রাত বারোটায় কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভাঙল ইফার। তাড়াতাড়ি গিয়ে খুলে দিল দরজা। জুয়েল এসেছে। সে ঘরে ঢুকতে নাকে বাজে একটা গন্ধ পেল ইফা। দেখল জুয়েলের চোখদুটো লাল। তাই জিজ্ঞেস না করে পারল না, ‘তোমার চোখ লাল কেন? আর এত বিচ্ছিরি গন্ধ কীসের?’
যেন ইফার কথা শুনতেই পেল না জুয়েল, সোজা বেডরুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়।
‘কই, বললে না যে? তোমার এ অবস্থা কেন?’
জুয়েল এবারও কোনও উত্তর দিল না।
‘আশ্চর্য! কথা বলছ না কেন? তা হলে কি তুমি…এ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’
খুব বিরক্তির সঙ্গে জুয়েল বলল, ‘কী বিশ্বাস হচ্ছে না?’
‘তুমি কি…মদ খেয়েছ?’
খুব জোরে হেসে উঠল জুয়েল, যেন ইফার প্রশ্নটা হাস্যকর। হেসে বলল, ‘হ্যাঁ।’
এ কথা শুনে মাথায় বাজ পড়ল ইফার। পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইল। নড়াচড়ার শক্তি পাচ্ছে না। বুঝতে পারছে না, এখন কী করবে। বিয়ের পর এই প্রথম জুয়েলকে এ অবস্থায় দেখছে।
.
সকাল দশটা।
জুয়েল জেগে উঠে দেখল, গতকালকের পোশাক এখনও পরনে। গতকাল রাতের কথা মনে পড়ল ওর। রুমে নেই ইফা। আওয়াজ আসছে রান্নাঘর থেকে। জুয়েল রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। ওকে দেখে সঙ্গে-সঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে নিল ইফা।
‘সরি, আই অ্যাম রিয়েলি সরি,’ বলল জুয়েল।
কিছুই বলল না ইফা। নিজ কাজে মন।
‘আসলে কালকে কিছু লোকের সাথে পরিচয় হয়েছে। তারাই জোর করে খাওয়াল। আমিও কিছু বলতে পারিনি। বোঝোই তো ব্যবসার খাতিরে অনেক কিছুই করতে হয়।’ গিয়ে পিছন থেকে ইফাকে জড়িয়ে ধরল জুয়েল।
ইফাও কোনও বাধা দিল না।
‘সরি…’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু আর কখনও যেন এমন না হয়।’
‘তুমি কষ্ট পেয়েছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘আর এমন হবে না।’
‘তুমি সারাদিন থাকো না, রাতেও আসো দেরি করে। আমার একা-একা খুব কষ্ট হয়।’
‘আসলে একটা নতুন কাজ পেয়েছি। তাই একটু বেশি সময় দিতে হচ্ছে।’