বাঘটা যখন আর মাত্র গজ দশেক পেছনে, আর দুই লাফেই ওর নাগাল পেয়ে যাবে, তখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত ঘাসের সঙ্গে পা জড়িয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল নুরু। আগের গতিবেগের কারণে বেশ কিছুদূর পিছলে গেল দেহটা। হাঁচড়েপাঁচড়ে ওঠার চেষ্টা করল ও, কিন্তু পারল না। বেকায়দায় পড়ে বাজেভাবে মচকে গেছে ওর ডান পা। কিন্তু এতক্ষণে তো বাঘটার ওর ওপরে এসে পড়ার কথা!
শরীর মুচড়ে বহু কষ্টে চিত হলো নুরু। এবং মুখোমুখি হলো এমন এক দৃশ্যের, যার কোনও ব্যাখ্যা দাঁড় করানো ওর পক্ষে অসম্ভব।
পাঁচ
ক্ষুধা! ইদানীং ক্ষুধার জ্বালায় বড্ড কষ্ট হয় মনসা তান্ত্রিকের। ব্রত গ্রহণের ফলে এবং নিজের অলৌকিক শক্তি ধরে রাখার জন্য একমাত্র মাংসাশী জন্তুর কলজে ছাড়া আর কিছু খাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ তার জন্য। কিন্তু মাংসাশী জীব টাকায় ষোলোটা মেলে না! এটা ঠিক যে সাধারণ মানুষের তুলনায় তার চাহিদা বহুগুণে কম। সাধনা করে অল্প খাদ্যে জীবন ধারণের ক্ষমতা অর্জন করেছে সে। কিন্তু কমেরও তো একটা সীমা আছে! আগে, বয়সকালে দেহে শক্তি ছিল অফুরান, এখন বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তন্ত্রমন্ত্রের শক্তি বাড়লেও দৈহিক শক্তি কমে গেছে তার। আর তার খাবার জোগাড়ের পথে সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান অন্তরায়।
আগে বাঘ-চিতাবাঘ শিকার করা তার কাছে কোনও ঘটনাই ছিল না। বনে ঢুকে খুঁজে বের করাই যা কঠিন, তারপর মেরে নিলেই হলো। কিন্তু এখন আর ওই ভয়াবহ জীবগুলোর সঙ্গে হাতাহাতি লড়াই করার ভরসা পায় না। শক্তি আর ক্ষিপ্রতা কমে গেছে, শিকার করতে গিয়ে নিজেকেই হয়তো শিকারে পরিণত হতে হবে! তাই ইদানীং ছোটখাট জীব-জানোয়ার, যেমন শিয়াল, খাটাস অথবা পাখি, যেমন চিল, শকুন, এমনকী ঠেকায় পড়লে কুকুর, বিড়াল বা কাকের কলজে পর্যন্ত খেতে হয় তাকে। এই লজ্জা সে কোথায় রাখবে? আর ওইসব পুঁচকে প্রাণীর কলজেতে না আছে স্বাদ, আর না ভরে পেট! তবু, বাঁচতে তো হবে!
আসলে সমস্যাটা পাকিয়ে তুলেছে বনের এক উপদেবতা। বছর দুই আগে তার পেয়ারের একটা বাঘিনীকে মেরে আয়েস করে ওটার কলজে খাচ্ছিল মনসা তান্ত্রিক। সে কি আর ছাই জানত ওটা উপদেবতার প্রিয় জানোয়ার? রেগে গিয়ে তাকে অভিশাপ দিয়েছে ওই দেবতা। বনের মধ্যে এখন আর ওই জাদুশক্তি কাজ করে না। আর তাই হাতাহাতি করতে হয় হিংস্র শ্বাপদের সঙ্গে!
কত দিন হয়ে গেল পেট পুরে খায় না সে!
শুকিয়ে প্যাকাটি মেরে গেছে একদা হৃষ্টপুষ্ট দেহটা!
ক্ষুধা, বড্ড ক্ষুধা।
ওই দিন নুরু ছেলেটার কীর্তি দেখে হঠাৎই একটা চিন্তা মাথায় এসেছে মনসা তান্ত্রিকের। এদিকের বনের ধারে একটা বাঘ থাকে। বেশ বড় একটা মদ্দা বাঘ। ওটার কলজেটা নিশ্চয়ই বিরাট হবে আকারে। ভাবলেই জিভে পানি এসে যায়! কিন্তু বনে ঢুকে ওটাকে মারার মুরোদ নেই মনসার। তবে কোনওভাবে ওটাকে বন থেকে বের করে আনতে পারলে হয়। জাদুশক্তি ব্যবহার করতে পারলে তাকে আর পায় কে? নুরু এদিকে ঘোরাফেরা করে, ওকে দেখে বাঘটা যদি শিকার করতে আসে, তা হলেই হবে। কেল্লা ফতে!
কপালটা ভালই বলতে হবে মনসার। বাঘটা খুব সম্ভব আগেও মানুষ শিকার করেছে। ওটার হাবভাবে মানুষের প্রতি পশুদের সহজাত যে ভয়, তার নজির দেখেনি মনসা তান্ত্রিক। অন্যদিকে নুরু ছোকরা সেদিন খামোকা শিঙ্গা বাজিয়ে নিজের একমাত্র অস্ত্রটা হারিয়ে ফেলেছে।
এই শিঙ্গা নিয়েও চিন্তিত ছিল মনসা। সে জানে যে ওটা বাজালেই এসে ভিড় জমাবে রাজ্যের লোকজন। তখন আর কিছুই তার পরিকল্পনা মাফিক সারা যাবে না। কিন্তু আটঘাট বাঁধা আছে। প্রথম দিন শিঙ্গা বাজিয়ে মস্করা করার পর কাজটা অব্যাহত রাখার জন্য নিজের অশুভ ক্ষমতা খাটিয়ে বারবার নুরুকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে ‘ প্ররোচিত করেছে মনসা তান্ত্রিক। আর তাই অবচেতন মনের তাগিদে নুরুও চালিয়ে গেছে ওই হঠকারিতা। ফলে এবারে আর কেউ আসবে না।
.
বাঘটা খুব সম্ভব ঝাঁপ দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, এমন সময় পেছন থেকে আক্রান্ত হয়েছে ওটা। আধশোয়া অবস্থায়, বিস্ফারিত চোখে, পায়ের অসহ্য ব্যথা ভুলে নুরু দেখল, বাঘটার পিঠের ওপর লেপটে আছে মানুষ সদৃশ এক জীব।
অশুভ কী যেন একটা আছে ওটার মাঝে। কঙ্কালসার শুকনো ওটার দেহ। সন্ধ্যার ম্লান আলোতেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে চামড়ার নিচ থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসা হাড়ের সমষ্টি। চার হাত-পায়ে তীক্ষ্ণ নখ ওটার। আর সেই নখ দিয়ে খামচে ঝুলছে আছে বাঘটার পিঠে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, বাঘটা এই অযাচিত সওয়ারকে তাড়ানোর বিন্দুমাত্র চেষ্টা করছে না। কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে বিশাল, ভয়াবহ ওই জন্তুটা; ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে আসছে ওটার সবুজাভ চোখ দুটো।
‘হিশ্! হিশ্!’ করে জান্তব একটা ধ্বনি বের হচ্ছে বাঘের পিঠের ওই বীভৎস সওয়ারটার মুখ থেকে। টপ-টপ করে ঝরে পড়ছে লালা। দেখা যাচ্ছে টকটকে লাল এবং অস্বাভাবিক লম্বা একটা জিভ! কাঁচাপাকা, জট পড়া লম্বা চুল তার বাতাসে উড়ছে। নখগুলো যেখানে আঁকড়ে আছে বাঘের শরীর, সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে মিশে যাচ্ছে কালো, ঘন ধোঁয়ার মত কী যেন! চামড়া ভেদ করে বাঘটার শরীরেও ঢুকছে ওই জিনিস! তার প্রভাবেই কি না কে জানে, দেখতে দেখতে একেবারেই নিভে গেল বাঘটার চোখের জ্যোতি। ভারসাম্য হারিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল ওটা ঘাসের মধ্যে।