প্রচণ্ড ক্ষুধা সেই চোখের মালিকের পেটে!
চার
দুই দিন পরের কথা। আগামীকাল নুরুর বিচারের জন্য সালিশ বসবে। এর আগেই ব্যাপারটা চুকিয়ে ফেলতে হবে ওকে। যদিও এবার আর ধরা পড়ার ঝুঁকি নেবে না। তবুও কোনও কারণে যদি আবার ধরা পড়েও যায়, সালিশের আগে হলেই ভাল সেটা। কারণ একবার রায় দিয়ে দিলে এটা গোটা গ্রামের মাথাব্যথা হয়ে যাবে। এখন ওর এই ‘বাঘ এসেছে! বাঘ এসেছে!’ খেলার কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে উত্তম-মধ্যম দেয়ার থেকে বেশি আর কিছু করতে পারবে না রহিম সরদার বা তার দলের লোকেরা, কিন্তু সালিশের কথা ভিন্ন। তাই যা করার আগেই করে নিতে চাইছে নুরু। হয়তো এবারেও ধরা পড়লে শাস্তি কিছু বাড়বে, কিন্তু তাতে এমন কিছু ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। এত কিছু ভাবতে পারল অথচ ওই হঠকারী কাজটা করা থেকে বিরত থাকার চিন্তা একবারও এল না ওর মাথায়। সত্যিই মানুষের মতিগতি বোঝা দায়!
আজও সন্ধ্যার কিছু আগে সেই গাছের নিচে এসে দাঁড়াল নুরু। ‘দেখি আজ কে আমাকে ধরে! যত্তসব বেরসিকের দল!’ বিড়বিড় করে কথাটা আউড়ে, অভ্যস্ত ভঙ্গিতে শিঙ্গা ফুঁকল ও। তারপর ঘুরেই দ্রুত পা চালাল বনের দিকে। উদ্দেশ্য: কেউ আসার আগেই বনে ঢুকে যাবে। তা হলে আর ধরা পড়ার ঝুঁকি থাকবে না। খুঁজতে এসে খামোকাই হয়রান হবে রহিম সরদার আর তার চেলারা। কাজের কাজ কিছুই হবে না। তারা সন্দেহ করতে পারলেও প্রমাণ করতে পারবে না, তা ছাড়া ওর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নতুন করে তেমন কিছু যোগও করবে না। বিচারে তেমন কিছু হবে না ওর। কারণ এই ঘটনার আগ পর্যন্ত গ্রামে বেশ একটা সুনাম ছিল ওর, তার উপর এতিম বলে এমনিতেই মানুষের সহানুভূতি আছে ওর উপর। হয়তো কিছু জরিমানা করা হবে। তা হোক গে। কিন্তু ব্যাটাদের তো খাটিয়ে মারা যাবে!
বনের সীমানার কাছে পৌঁছে একবার ফিরে দাঁড়িয়ে পেছন পানে চাইল নুরু। নাহ্, এখনও কারও টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য যাবার কথাও না। লোকজন জড় হয়ে আসতে যতটা সময় লাগে, ততক্ষণ পার হয়নি এখনও। তবে আর বেশি দেরি করাটাও ঠিক হবে না। ভেবে যেই আবার বনের দিকে ঘুরেছে, অমনি জায়গায় বরফের মত জমে গেল নুরু। অস্ফুট একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল ওর গলা চিরে। ভয়ে, বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছে মুখটা।
গজ পঞ্চাশেক সামনে চোখে পড়ছে একটা ঝোপ। সেই ঝোপের ভেতর থেকে ধীর গতিতে বেরিয়ে আসছে কী ওটা!
‘মামা!’ মৃদু কণ্ঠে উচ্চারণ করল নুরু। সমস্ত শরীর যেন জমে গেছে ওর।
বিশালদেহী হলদে জানোয়ারটা পুরোপুরি বেরিয়ে এল ঝোপ ছেড়ে। শেষ বিকেলের রক্তিম আলোয় অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে ওটার ডোরাকাটা দেহটাকে। সবুজাভ চোখ দুটো স্থির হয়ে আছে নুরুর উপর। সন্তর্পণে ওর দিকে এক পা এগোল ওটা। তারপর আরেক পা।
নুরুর পায়ে যেন শেকড় গজিয়ে গেছে! চেষ্টা করেও নড়তে পারছে না ও। বনের ধারে বাস হলেও আগে কখনও এরকম সামনা-সামনি ৰাঘ দেখেনি ও। বাঘে খেয়ে যাওয়া গরু দেখেছে কয়েকবার। পায়ের ছাপও চোখে পড়েছে। গঞ্জে গিয়ে একবার সার্কাসের খাঁচায় বন্দি বাঘও দেখেছিল। কিন্তু বনের বাঘের সামনে এই প্রথম। কিংকর্তব্য স্থির করতে পারছে না নুরু। এমন সময় হঠাৎ গলায় ঝুলানো শিঙ্গাটা হাতে ঠেকল ওর।
তাই তো! একটু আগেই তো তিনবার ফুঁকেছে ওটা। এতক্ষণে তো চলে আসার কথা রহিম সরদার আর তার দলবলের। একটু আগেই যাদের কাছ থেকে পালাতে যাচ্ছিল, এই মুহূর্তে সেই তাদেরই আগমনের জন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা শুরু করল ও। আর কতক্ষণ লাগবে ওদের পৌঁছতে? আবার শিঙ্গা ফুঁকে দেখবে নাকি, যদি তা হলে তাড়াতাড়ি আসে?
বাঘটা এখনও স্থির দাঁড়িয়ে আছে। কেন যে ওটা সময় নিচ্ছে, তা নুরু জানে না। কিন্তু দেরি করছে বলে মনে কিছুটা আশা জাগছে ওর। হয়তো সময় মত এসে পড়বে রহিম সরদার। খুব ধীরে ধীরে শিঙ্গাটাকে আবার মুখের কাছে তুলল ও। মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্যেও বাঘটার উপর থেকে চোখ সরাচ্ছে না।
.
পর পর তিনবার শিঙ্গা বাজার মানে বাঘ এসেছে। এই তল্লাটে এটা এক অলিখিত নিয়ম। কিন্তু গত কয়েক দিনে নিয়মের ব্যতিক্রম কম হয়নি। তাই এবারও যখন টিলার অপর পাশ থেকে বেজে উঠল শিঙ্গা, দেখতে যাবার কোনও দরকার নেই বলে সিদ্ধান্ত দিল রহিম সরদার। ‘ওই নুরু ছ্যামড়ার কাম এইডা!’ জোর গলায় ঘোষণা করল সে। ‘হালার বাইচলামি কাইলকা সালিশের সময় বাইর করুম! তোমাগো ওই দিক কান দেওনের কাম নাই!’
অন্য সবাই সমর্থন জানাল তার এই সিদ্ধান্তকে।
কিছুক্ষণ পর একই দিক থেকে আবারও শোনা গেল শিঙ্গার শব্দ। তবে এবারে মাত্র একবার।
‘ওই দ্যাখ, আমরা কেউ যাই নাই দেইখা হালায় আবার বাজায়! বদমাইশ জানি কোনেকার!’ মুখ খিঁচিয়ে গাল দিল সাদেক নামের একজন।
‘কান দিস না!’ অন্য একজনের সংক্ষিপ্ত জবাব।
যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রাখালেরা। সন্ধ্যায় সব গরু-মোষ জড় করে গুনতে হয়, তারপর বাড়ি ফেরার পালা। সেদিকে মন দিল সবাই।
.
শিঙ্গার শব্দ কানে যেতেই ভয়ানক বেগে নুরুর দিকে ধেয়ে এল বাঘটা। আঁতকে উঠে প্রাণপণে উল্টো দিকে ছুট দিল নুরু। শিঙ্গায় দ্বিতীয় ফুঁ দেবার আর সুযোগ পেল না।
কথায় আছে জানের মায়া বড় মায়া। এমনিতেই বেশ ভাল দৌড়াতে পারে ও, তার উপর এখন ভয় আর জীবনের প্রতি টান বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে ওর গতি। কিন্তু, বাঘের সঙ্গে দৌড়ের পাল্লায় মানুষের কোনও আশা থাকে না। ওর বেলাতেও তার ব্যতিক্রম হলো না। ক্রমশ কমে আসতে লাগল দুইয়ের মাঝের দূরত্ব।