যেমন ভাবা তেমন কাজ। গাছটার উপরের দিকে ঘন পাতার আড়ালে নিজেকে ভাল মত লুকিয়ে বসল নুরু। তারপর যথারীতি ফুঁকল শিঙ্গাটা পর পর তিনবার!
.
রহিম সরদার বা অন্য যারা মাঠে গরু চরায়, তারা স্বপ্নেও ভাবেনি যে সেদিনের ঘটনার পর আবার কেউ এই বিষয় নিয়ে ফাজলামি করতে পারে। তাই শিঙ্গার আওয়াজ কানে যেতে সেটাকে স্বাভাবিক গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করল সবাই। এবং লাঠিসোটা নিয়ে তেড়ে গেল শব্দ লক্ষ্য করে।
দলটা যখন হাঁপাতে হাঁপাতে নেমে এল টিলা পেরিয়ে, পশ্চিম আকাশে সূর্য তখন অস্ত যেতে বসেছে। কিন্তু কীসের কী! খাঁ-খাঁ করছে গোটা তল্লাট। কোথাও কেউ নেই। থতমত খেয়ে গেল ওরা।
তবে কি কেউ ছিল, কিন্তু বাঘে ধরে নিয়ে গেছে বেচারাকে?
ফিসফাস করে জল্পনা-কল্পনা শুরু করল সবাই।
বল্লমে ভর দিয়ে ভুরু কুঁচকে দাঁড়াল রহিম সর্দার। কী যেন ভাবছে।
‘কী চিন্তা করো, রহিম ভাই?’ জানতে চাইল দলের একজন।
‘শিঙ্গাডা বাজাইল কেডা?’ আপন মনে মাথা নাড়ল রহিম সরদার। তারপর সবাইকে বলল এলাকাটা তল্লাশি করার জন্য। বাঘের পায়ের ছাপ বা অন্য কোনও চিহ্ন চোখে পড়ে কি না দেখতে হবে।
‘ভালা কইরা দেখ, ভাইয়েরা, মামায় নিয়া থাকলে রক্তের দাগ থাইকবো!’ সবাই যাতে শুনতে পায় তাই চেঁচিয়ে বলল জব্বার আলী।
গাছের উপর থেকে ওদের কাণ্ড দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসছে তখন নুরু। ও যতটা
ও যতটা ভেবেছিল, বিষয়টাকে তারচেয়েও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে জনতা। দেবেই তো, তারা তো আর জানে না যে বাঘের আগমনের ব্যাপারটা ভুয়া। অবশ্য ওদের ছুটোছুটি করাটাই সার হবে, কারণ বাস্তবে তো আর কোনও বাঘ আসেনি!
‘এইবার মজা বুঝ!’ নিজের মনেই বিড়বিড় করল নুরু। ‘ওই দিন মজা করছিলাম হেইডা ভাল্লাগে নাই, এখন?’ পুরো ব্যাপারটার সার্থকতা চিন্তা করে পারলে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিত ও।
ওদিকে সবাই খোঁজাখুঁজিতে ব্যস্ত হলেও রহিম সরদার কিন্তু তাতে যোগ দেয়নি। সন্দেহ দানা বেঁধেছে তার মনে। এমনিতেই কেউ আসে না এদিকটায়, তাও ধরা যাক কেউ এসেছে, কিন্তু তা হলে তার গরু-মোষ কোথায় গেল? রাখাল ছাড়া অন্য কারও তো শিঙ্গা নিয়ে চলাফেরার করার কথা না। আর গরু চরানো ছাড়া অন্য কী কাজ থাকতে পারে বিজন জায়গাতে?
ওই দিন নুরুর ভাবগতিক ভাল ঠেকেনি তার, হয়তো আবার মস্করা করেছে ছোকরা। যদিও সেই সাহস ওর হবার কথা না, কিন্তু বলা যায় না। নুরু বা অন্য কেউ যদি শয়তানি করে ওই শিঙ্গা ফুঁকে থাকে, তা হলে খুব সম্ভব এদিকেই কোথাও লুকিয়ে আছে সে। কারণ গাঁয়ে ফেরার পথে গেলে দলের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়ে যেত। আর এই ভর সন্ধ্যায় বনের মধ্য দিয়ে ঘুরপথে বাড়ি ফেরাটা যে কারও জন্য অস্বাভাবিক। আর এদিকে যদি কেউ লুকিয়েই থাকে, তার জন্য আদর্শ জায়গা হচ্ছে ওই বড় ঝাঁকড়া গাছটা। সাতপাঁচ ভেবে সিদ্ধান্ত নিল রহিম সরদার। যেই ভাবা, সেই কাজ, বল্লমটা মাটিতে গেড়ে গাছ বেয়ে ওঠা শুরু করল সে।
এদিকে এমন কিছু ঘটতে পারে, সেটা হিসাব করেনি নুরু। ও ভেবেছিল, কাউকে না দেখে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ গজগজ করে বিদায় নেবে দলটা। তার বদলে এমন আতিপাতি করে পুরো এলাকা খুঁজে দেখবে, এমনকী গাছেও চড়বে, তাও আবার রহিম সরদার স্বয়ং, এমনটা ওর মাথায় খেলেনি। নুরু যতটুকু চিনত, তাতে করে ভেবেছিল পেশিসর্বস্ব বোকা কিসিমের লোক রহিম সরদার। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বাস্তবে ঘটে যথেষ্ট বুদ্ধি ধরে লোকটা 1
আর লুকিয়ে থেকে লাভ নেই বুঝতে পেরে পাতার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ও। মনে মনে নিজেকেই গাল দিচ্ছে। উচিত ছিল শিঙ্গাটা বাজিয়েই ঘুরপথে চম্পট দেয়া। তা হলে আর এই বিপদে পড়তে হত না।
গতবারের সাক্ষাতে যেখানে ছিল উদ্বেগ, এবার সেখানে জায়গা করে নিল রাগ। নুরুকে দেখেই গলার রগ ফুলিয়ে চেঁচিয়ে সবাইকে ডাকল রহিম সরদার। ওরা গাছ থেকে নামার আগেই নিচে জড় হলো সবাই। হতাশ চোখে লক্ষ্য করল নুরু, একটা মুখও বন্ধুভাবাপন্ন নয়। মনে মনে আবার নিজের বোকামির জন্য শাপশাপান্ত করল ও নিজেকে।
এদিকে রাগে ফেটে পড়েছে জনতা। এই মিথ্যা সংকেত দেয়াটা কী ধরনের ফাজলামি, সেই কৈফিয়ত চাইছে সবাই। নুরু মাটিতে স্থির হয়ে দাঁড়াতেই ওর গালে কষে এক চড় বসিয়ে দিল রহিম সরদার। নুরুর মনে হলো মুগুর দিয়ে বাড়ি মারা হয়েছে ওকে। চোখের কোণ দিয়ে পানি বেরিয়ে এল ব্যথার চোটে। অনুভব করল ফেটে গেছে ঠোঁটের একপাশ।
তবু ওর কপাল ভালই বলতে হবে। ওই একটা চড়ই যা, এরপর আর কেউ গায়ে হাত তুলল না ওর। তবে তাই বলে ভর্ৎসনা করার বেলায় কেউ কারও থেকে কম গেল না। বিষয়টা নিয়ে শীঘ্রিই সালিশ বসবে গাঁয়ে, এই মর্মে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দল বেঁধে বিদায় নিল সবাই। ততক্ষণে পেরিয়ে গেছে সন্ধ্যা। কিন্তু তবু একবারের জন্যও নুরুকে সঙ্গে যেতে বলল না কেউ।
স্তব্ধ হয়ে বনের প্রান্তে একা দাঁড়িয়ে রইল নুরু। চড় খেয়ে ব্যথায় মুখের বাম পাশ টনটন করছে ওর। কিন্তু মনের মাঝে যে জ্বলুনি হচ্ছে, তার তুলনায় ওটা কিছুই না। নিজের দোষটা সহজে চোখে পড়ে না মানুষের, কথাটা নুরুর বেলাতেও সত্যি। ওর সঙ্গে কী করা হয়েছে, সেটাই নজর কাড়ছে ওর। কিন্তু নিজে কী করেছে, সেটা বেমালুম ভুলে গেছে। আরও বেশ কিছুক্ষণ পর ও যখন গাঁয়ের পথ ধরল, ততক্ষণে আকাশের কোণে দেখা দিয়েছে চাঁদ। তার ম্লান আলোয় পথ চলতে চলতে জেদের সঙ্গে ভাবল নুরু, এখানেই শেষ নয়! আরও নিখুঁত কায়দা করে কাজ সারবে পরের বার। খাটিয়ে রহিম সরদারের হাড় কালো না করলে ওর শান্তি হবে না! কিন্তু এইসব ভাবতে ভাবতে পথ চলার সময় ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করল না, অদূরেই বনের প্রান্তে ঝোপের মধ্য থেকে ওর উপর নজর রাখছে জ্বলজ্বলে একজোড়া চোখ।