সে যা-ই হোক, শব্দটা এসেছে টিলার অন্যপাশ থেকে। এদিকে যারা ওই দিন পশু চরাচ্ছিল, তাদের মাঝে খেলে গেল একটা চাঞ্চল্য। রাখালদের নেতা রহিম সরদার মোষ চরানোর পাশাপাশি লাঠি খেলাতেও পারদর্শী। বিশালদেহী, শক্তিশালী লোক সে। সাহসেরও কমতি নেই। প্রথমে সে-ই করিতকর্মা হলো। হাঁক-ডাক করে নিমিষের মধ্যেই জনা বিশেক লোক জড় করে ফেলল রহিম। উত্তেজনায় বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে, আর সমানে শাপ-শাপান্ত করছে। ‘ওই চুলোয় মরতে গেছে কোন্ ব্যাটা?’ মাটিতে পা দাপিয়ে জব্বার আলী নামের শুকনো মত চেহারার এক বুড়োকে জিজ্ঞেস করল রহিম, ‘জানে না ওই দিকটা ভালা না! মামা ঘোরাফেরা করে ওই দিকে, এইডা কি নতুন খবর?’
স্থানীয়ভাবে বাঘকে মামা নামেই ডাকে ওরা, বাঘ শব্দটা পারতপক্ষে উচ্চারণ করতে চায় না।
পিচিক করে পানের পিক ফেলে মুখ বিকৃত করল জব্বার, ‘এহন কি আর ওইসব চিন্তা করনের সময় আছে? আগে চল গিয়া দেইখা আসি অবস্থাডা কী?’
‘কইলেই কি যাওয়া যায়, মামা বইলা কথা!’ ভীতু প্রকৃতির হারুন মিয়া অন্য পাশ থেকে ফোড়ন কাটে।
‘মামা হইছে তো কী হইছে? আমরা এত্তগুলান লোক-হুদাই ভয় খাইস না!’ বলতে বলতে এক সাগরেদের কাছ থেকে লম্বা একটা বল্লম লুফে নেয় রহিম সরদার, ‘চল, ভাইরা, গিয়া দেখি কার কপাল পুড়ল!’
.
ওদিকে গাছের ডালে আয়েস করে পা ঝুলিয়ে বসে ছিল নুরু। একটু আগে যে বিড়িগুলো বেঁধেছিল, তারই একটা ধরিয়ে মনের সুখে টানতে টানতে নিজ মনেই হাসছিল। টিলার ঢাল বেয়ে শোরগোল করতে করতে নেমে আসা লোকজন দেখে গাছের গায়ে ঘষে বিড়িটা নিভিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলল ও। দলের মাঝে মুরুব্বি কিসিমের লোক থাকবেই। মস্করা করা এক জিনিস আর বেয়াদবি আরেক। তরতর করে গাছ থেকে নেমে অগ্রসরমান দলটার দিকে এগিয়ে গেল ও।
দূর থেকে ওকে দেখে হেঁকে উঠল রহিম সরদার, ‘ক্যাডারে? নুরা নাকি? ঠিক আছোস তুই?’
‘হ চাচা, ঠিকই আছি।’ একটু ইতস্তত করে উত্তরটা দিল নুরু, মনে মনে একটু ঘাবড়ে গেছে। রহিম সরদারকে দলের পুরোভাগে আশা করেনি ও, কারণ কয়েক দিন আগে শ্বশুর বাড়ি গিয়েছিল লোকটা। ফিরেছে যে, তা নুরু জানত না। বদমেজাজি লোকটাকে একটু ভয়ই পায় ও। রহিম সরদার ভালর ভাল, খারাপের যম। রেগে গেলে দু’চারটা চড়- থাপ্পড়ও দিয়ে বসতে পারে। ওই লোকের পেল্লায় হাতের চড় খেলে আর দেখতে হবে না। একবার ওর ঝোঁক চাপল যে সত্যিই বাঘ এসেছিল দাবি করে বসে। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নাকচ করে দিল চিন্তাটা। অভিজ্ঞ লোক রহিম সরদার, আর সঙ্গে জব্বার আলী বুড়োও আছে। বাঘের চিহ্ন খুঁজে না পেলে ও যে মিথ্যা বলছে, ঠিকই তা বুঝে যাবে ওরা। আরও বেশি রেগে যাবে। তখন আর শুধু চড়-থাপ্পড় দিয়ে রেহাই দেবে না। কে জানে, গ্রামে নিয়ে হয়তো সালিশই ডেকে বসবে!
বিষয়টা নিয়ে বেশি ভাবনা-চিন্তা করার সুযোগ মিলল না নুরুর। দ্রুতই ওর কাছাকাছি চলে এল দলটা। ‘কী ব্যাপার, নুরা? মামা আইছিল? কিছু নিছে নাকি?’ হাঁপাতে হাঁপাতে প্রশ্ন করল হারুন মিয়া। এই মুহূর্তে বাঘের মুখোমুখি হতে হবে না বুঝতে পেরে হম্বিতম্বি বেড়ে গেছে তার।
‘হ, নুরু ভাই, কিছু খোয়া গেছে নি?’ ওর বছর দুয়েকের ছোট আউয়ালও কৌতূহল প্রকাশ করল।
রহিম সরদার অবশ্য প্রশ্ন করার ধার ধারছে না। দলের লোকজনকে নুরুর গরু-মোষগুলো জড় করতে বলল সে। গোটা বারো পশু চরায় নুরু। ও একাই ওগুলোকে সামলাতে পারে। এতগুলো লোকের পক্ষে ওই কটা জন্তু পাকড়াও করা কোনও কাজই নয়। তবু বাঘের উপস্থিতি বলে কথা।
‘আসলে, কাকা,’ রহিমকে অন্যদিকে মন দিতে দেখে হালে পানি পেয়েছে নুরু, জব্বারকে উদ্দেশ্য করে বলল ও, ‘হইছে কী জানেন…
‘কী?’ বকের মত গলা বাড়িয়ে ওর দিকে ঝুঁকে এল বুড়ো। কৌতূহল তারও কম নেই।
‘আসলে…’ আমতা আমতা করতে লাগল নুরু, ঠিক কী বলবে সাজিয়ে নিতে চেষ্টা করছে।
‘ধুর, মিয়া, তাত্তারি কও তো, কোন্ দিকে গেছে মামাডা?’ পাশ থেকে তাড়া লাগাল একজন।
‘আসলে মামা আসেই নাইক্কা!’ হড়বড় করে বলে ফেলল নুরু।
তিন
দিন তিনেক পরের কথা। মেজাজ খারাপ করে সেদিনের ওই গাছটার নিচে বসে আছে নুরু। আসলে গত তিন দিন ধরেই মাথাটা গরম হয়ে আছে ওর। সামান্য একটা মজাও বোঝে না এই গাঁয়ের লোকগুলি। ছেলেবেলায় একবার দূরের এক গঞ্জে বেড়াতে গিয়েছিল নুরু। ওখানে দেখেছে যে মানুষ গাঁটের পয়সা খরচ করে ভাঁড়ামি দেখে। ঠকার জন্য ইচ্ছা করে টাকা ফেলে শহুরে বাবুরা! আর ওর নিজের গ্রামের গেঁয়ো ভূতের দল! একটু তামাশা করেছে বলে ওই দিন ওকে কান ধরে ওঠা-বসা করিয়েছে রহিম সরদার। বলেছে ফের এমন হলে মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেবে! ব্যাটার যেমন মোষের মত শরীর, মারলে হাড় গুঁড়ো হয়ে যাবারই কথা।
বেগতিক দেখে অবশ্য যুক্তি দিয়ে ব্যাটাদের বোঝাতে চেয়েছিল ও। কিন্তু সেকথাও কেউ কানে তোলেনি। তুলবেই বা কেন? কতক্ষণে সাহায্য আসে এটা যাচাই করার জন্য ‘বাঘ এসেছে’ এহেন মিথ্যা সংকেত দেবার যুক্তি ধোপে টেকার কথা নয়।
তবে ওর নামও নুরু! শোধ না নিয়ে ছাড়বে না। আর কিছু না হোক, ওই রহিম সরদার আর তার চেলাদেরকে বেগার খাটাবে ও। তার জন্য যদি নিজের বিপদ হয়, তাও সই! অবশ্য ধরা না পড়লে আবার বিপদ কী! যেমন ভাবা, তেমন কাজ। আজ আটঘাট বেঁধেই এসেছে ও। গরু-মোষ আনেনি আজ। আগের দিন ওগুলো এক বন্ধুকে বুঝিয়ে দিয়ে বলছে, ও দূরের এক গাঁয়ে বেড়াতে যাবে আজ। তারপর ঘুরপথে এদিকে এসে ঘাপটি মেরে বসে আছে। উদ্দেশ্য আর কিছুই না। সন্ধ্যার আগে আগে শিঙ্গা ফুঁকে বাঘ আসার সংকেত দেবে ও। ওই সংকেত পেলে খোঁজ নিতে না এসে উপায় থাকবে না রহিম সরদারের। তবে এইবার আর দেখা দেবে না নুরু। গাছের মগডালে উঠে লুকিয়ে থাকবে। দেখবে, ব্যাটাদের নিষ্ফল ঘোরাঘুরি করে গলদঘর্ম হবার দৃশ্য। ওটাই হবে ওদের জন্য উচিত শিক্ষা!