.
বিশাল অরণ্যের কোলে কেউ বহুকাল আগে পত্তন করেছিল এই বসতির। ক্রমে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে বিশাল এক জনপদ। তার করাল আগ্রাসনে বনভূমি আজ হুমকির মুখে। তবে হারানো দিনের মহিমা আজও কিছুটা অবশিষ্ট আছে।
বিশাল বিশাল মহীরুহ আর তার ছায়াতে বেড়ে ওঠা ঘন ঝোপঝাড়ে ছাওয়া গহীন বন এবং গ্রামের মাঝে রয়েছে এক চিলতে ঘেসো জমি। সেখানে চরে বেড়ায় গরু-মোষের পাল। স্থানীয় অনেকেরই জীবিকা নির্ভর করে এই চারণভূমির উপর।
পশুপালন নির্ভর জনপদ, আর তাই বাঘ বা চিতাবাঘের কবলে গরু-মোষের মৃত্যু ঘটলে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায় পশুপালকের। এমনি একটা গরু অসুস্থ হলে আর কিছু না হোক, জবাই করে ওটার মাংস খাওয়া যায় কাজে আসে চামড়াটাও। কিন্তু বাঘে নিলে লবডঙ্কা। তা ছাড়া, শুধু পশুই না, জানেরও তো ভয় আছে। যদিও মানুষখেকোর দেখা কদাচই মেলে। কিন্তু তবু ঝুঁকি কম নয়।
গবাদি-পশু চরানোর সময় প্রত্যেকেই একটা শিঙ্গা রাখে সঙ্গে। কেউ বিপদে পড়লে ওটা বাজিয়ে অন্যদের সংকেত দেয়া যায়। পর পর তিনবার শিঙ্গা ফুঁকলে সবাই বুঝবে বাঘ এসেছে! ওটাই এই এলাকায় বিপদের সর্বোচ্চ সীমা।
চারণভূমিটা এমনিতে সমতল হলেও উত্তর ধারে একটা ছোট্ট টিলা মত আছে, সেটা পেরিয়ে অন্যপাশে গেলে পাওয়া যাবে অর্ধবৃত্ত আকৃতির ঢালু একটা জমি। ওটা আকারে একর দশেকের মত। চমৎকার ঘাস হলেও সাধারণত কেউ পশু চরাতে যায় না ওদিকে। কারণ টিলার পেছনে বলে গ্রাম থেকে একটু বেখাপ্পা রকমের আড়ালে জায়গাটা। তা ছাড়া, বড় বেশি বনের গা ঘেঁষা। যে-কোনও সময় হিংস্র কোনও শ্বাপদের আগমন ঘটার সম্ভাবনাটাও বেশি ওদিকে।
হাঁটু সমান বয়স থেকেই গরু চরায় নুরু। এখন ও সদ্য কৈশোর পেরোনো তরুণ। চমৎকার স্বাস্থ্য আর সুদর্শন চেহারার সঙ্গে মানানসই অমায়িক ব্যবহারের কারণে গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবার প্রিয় পাত্র ও। তা ছাড়া, অল্প বয়সে এতিম হয়েছে বলে গ্রামের সবাই সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখে ওকে। অন্যসব দিনের মত আজও গরু চরাতে বেরিয়েছিল ও। দুপুরের পর হঠাৎ আবিষ্কার করল, অন্যমনস্কভাবে ঘুরতে ঘুরতে ওর পালটা চলে গেছে টিলার অন্যপাশের ঢালু জমিটাতে। প্রথমেই যে চিন্তাটা ওর মাথায় এল, তা হচ্ছে—এদিকে আসাটা কি ঠিক হলো? বিপদ-আপদ হলে সাহায্য পেতে সমস্যা হবে। কিন্তু একটু পরেই চিন্তাটাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিল ও মাথা থেকে। গত বেশ কয়েক মাসে একবারও হামলা চালায়নি বাঘ বা চিতা জাতীয় কোনও প্রাণী। গ্রামে দু’চারবার শিয়ালে মুরগি নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই খোয়া যায়নি। খামোকাই চিন্তা করে মরে বুড়োরা! মনে মনে পল্লী-সমাজের নীতি নির্ধারকদের প্রতি তাচ্ছিল্য মিশ্রিত বিরক্তি বোধ করল ও।
কেউ না আসায় এদিকের ঘাসগুলো ইচ্ছামত বেড়ে উঠেছে। এই ঘাস পেলে অচিরেই হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠবে ওর পালের গরু। এখন থেকে এদিকেই আসতে হবে, ভাবল ও।
পশুগুলোকে ইচ্ছামত চরে খেতে দিয়ে একটা মোটা গাছের গুঁড়িতে পিঠ দিয়ে বসল নুরু। কোমরে গোঁজা থলে থেকে তামাকের সরঞ্জাম বের করে বিড়ি বাঁধতে শুরু করল। গুনগুন করে একটা সুর ভাঁজছে মনের সুখে। ধূমপান আর আলস্য করে বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত করল ও। তারপর আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াল। পশ্চিম আকাশ দেখে অনুমান করল, আর দেড় কি দুই ঘণ্টা পর অস্ত যাবে সূর্য। মানে কিছুক্ষণের মধ্যেই গরু-মোষগুলো জড় করে ফিরতি পথ ধরা উচিত।
তামাকের সরঞ্জাম গুছিয়ে কোমরে গুঁজতে গিয়েই ওর হাতে ঠেকল শিঙ্গাটা। এবং হুট করে মাথায় খেলে গেল একটা দুষ্ট বুদ্ধি। আচ্ছা, একটা মস্করা করলে কেমন হয়?
মাথায় চাপা দুর্বুদ্ধিটাকে মনে মনে উল্টে পাল্টে দেখল নুরু। যতই ভাবল, শয়তানিটা করার ইচ্ছা ততই চাগিয়ে উঠল ওর মনে। যেন ওর মাথার ভেতর বসে দুষ্ট বুদ্ধি দিচ্ছে কোনও তৃতীয় পক্ষ!
সব সময়ই দেখা যায় যে সুবুদ্ধি সহজে না খেললেও শয়তানি খুব দ্রুতই খেলে মানুষের মাথায়। বিশেষ করে অল্পবয়সীদের মাঝে মস্করা করার প্রবণতা প্রকট হয়ে থাকে। নুরুও তার ব্যতিক্রম নয় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেল ওর। এমন তো না যে কারও ক্ষতি করতে যাচ্ছে-সামান্য একটু মজা করবে মাত্র! যেই ভাবা, সেই কাজ—একটু আগে যে গাছটার গোড়ায় বসে ছিল, সেটা বেয়েই বেশ কিছুটা উপরে উঠে গেল ও। মোটা একটা ডালে আয়েস করে পা ঝুলিয়ে বসে প্রস্তুত হয়ে নিল, তারপর গলায় ঝুলানো শিঙ্গাটা ঠোঁটে তুলে জোরে জোরে ফুঁ দিল তাতে। পর পর তিনবার!
দুই
শিঙ্গার তীব্র, তীক্ষ্ণ আওয়াজ খানখান করে দিল শান্ত বিকেলের নীরবতা। এ ধরনের শিঙ্গা তৈরিই করা হয় বহুদূর থেকে সংকেত দেবার জন্য। তাই এর শব্দ যে জোরালো হবে, সে তো জানা কথা। স্থানীয় লোকজন এই শব্দের সঙ্গে সুপরিচিত। এবং এটা মোটেই তাদের প্রিয় কোনও সুর নয়। বিপদ সংকেত পেলে কারও মন উৎফুল্ল হয় না, বরং শঙ্কাই জাগে। তার উপর নুরু ফুঁ দিয়েছে তিনবার। এর অর্থ এলাকার সবাই জানে। মহা বিপদ সংকেত-বাঘ এসেছে!
বাঘ! হলুদের উপর কালো ডোরাকাটা ভয়ঙ্কর সুন্দর ওই জানোয়ারটাকে সমীহ করে চলে সবাই, ভয়ও পায়। প্রকৃতিপ্রদত্ত অমিত শক্তির অধিকারী ওই শ্বাপদ আক্রমণ করলে প্রাণ নিয়ে ফেরা কঠিন। শিঙ্গাটা তিনবার বেজেছে। তার মানে, হয় খুব কাছে-পিঠেই আগমন ঘটেছে বাঘের। অথবা কপাল খারাপ হলে হয়তো গরুর পালে ঝাঁপিয়েই পড়েছে ওটা। ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়ার চিন্তা বাদ, কারণ তা হলে আর শিঙ্গা বাজানোর সুযোগ হত না বাদকের।