সে বছরই সুমনকে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল। সকালে সুমনের বাবা তাঁর সঙ্গেই সুমনকে নিয়ে বেরোতেন। স্কুলে পৌঁছে দিয়ে তিনি অফিসে চলে যেতেন। স্কুল ছুটির সময় সুলতানা বেগম গিয়ে সুমনকে নিয়ে আসতেন।
সুমনের বাবা খিচুড়ি আর ডিম ভাজা অত্যন্ত তৃপ্তি সহকারে খান। খেতে-খেতে বলেন, ‘সুলতানা, প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি, যখন-তখন চলে যেতে পারে। ভেবে রেখেছি, যদি কখনও সত্যিই চাকরি চলে যায়, তা হলে একটা খিচুড়ির দোকান দেব। তোমার হাতের কয়েক ধরনের খিচুড়ি থাকবে। চাল-ডাল-আলুর সিম্পল খিচুড়ি। সবজি খিচুড়ি। ডিম খিচুড়ি। গরুর মাংসের, খাসির মাংসের, মুরগির মাংসের, হাঁসের মাংসের আলাদা-আলাদা ভুনা খিচুড়ি। পাঁচমিশালি পাতলা খিচুড়ি। দেখবে হু-হু করে চলবে। তোমার হাতের রান্নার যে স্বাদ! লোকজনের লাইন পড়ে যাবে।’
খাওয়া শেষ করে বাপ-বেটায় রওনা দেয়। অবশ্য সুমন সেদিন খিচুড়ি খায়নি। খিচুড়িতে বোম্বাই মরিচ দিয়েছিলেন বলে অনেক ঝাল হয়েছিল। সুমন খেয়েছিল পাউরুটি আর দুধ।
রওনা দেয়ার সময় সুমনের বাবা ছেলেকে এড়িয়ে শেষ বারের মত সুলতানা বেগমের কপালে একটা চুমু খেয়েছিলেন। আর পাঁচশো টাকা সুলতানা বেগমের হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘সুমনকে স্কুল থেকে নিয়ে আসার সময় এই টাকা দিয়ে আধ কেজি গরুর মাংস আর একটা বাচ্চা মুরগি কিনে আনবে। পোলাওয়ের চাল বোধহয় ঘরেই আছে? না থাকলে আধ কেজি পোলাওয়ের চালও আনবে। বাচ্চা মুরগির রোস্ট, ভুনা গরুর মাংস আর পোলাও রান্না করবে।’
সুলতানা বেগম জিজ্ঞেস করেন, ‘অফিস থেকে ফিরবে কখন?’
সুমনের বাবা বলেন, ‘রোজ যে সময় ফিরি। অফিস ছুটি হলেই।’
সুলতানা বেগম মুখ বেজার করে বলেন, ‘আজ একটু তাড়াতাড়ি ফেরা যায় না? সন্ধ্যার আগে। তিনজন মিলে কোথাও ঘুরতে যেতাম।’
সুমনের বাবা বলেন, ‘চেষ্টা করে দেখব। তুমি না হয় সুমনকে নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে এসো।’
সুলতানা বেগম আরও মুখ ভার করে বলেন, ‘তোমাকে ছাড়া একা কোথাও যেতে আমার ভাল লাগবে?’
‘একা কোথায়, সুমন থাকবে না সাথে?’
‘সুমন তো থাকবেই, তোমার অভাব কি তাতে পূরণ হবে?’
সুমনকে স্কুল থেকে আনার সময় সুলতানা বেগম গরুর মাংস আর বাচ্চা মুরগি কেনেন। আধ কেজি গরুর মাংস আর বাচ্চা মুরগি কেনার পরও হাতে বেশ কিছু টাকা থেকে যায়। ‘সেই টাকা দিয়ে এক পোয়া মুগ ডাল, গরম মশলা আর টমেটো-ক্ষীরা কিনে ফেলেন। ভাবেন, আর একটা পাইটেম বাড়াবেন। বাচ্চা মুরগিটার পাখনা- চামড়া-গিলা-কলিজা দিয়ে মুগ ডালের ঘণ্ট করবেন। আর ওসব খাবারের সঙ্গে সালাদ না হলে চলে? তাই টমেটো-ক্ষীরা দিয়ে সালাদ বানাবেন।
সুলতানা বেগম দুপুরেই সব কিছু রান্না করে ফেলেন। তবে তিনি ওসব রান্নার কিছুই খান না। সকালের খিচুড়ি খানিকটা রয়ে গিয়েছিল। সেই ঠাণ্ডা খিচুড়িই খেয়ে নেন। দুপুরে খাওয়ার জন্য সুমনের বাবাকেও হটপটে খিচুড়ি দিয়ে দিয়েছিলেন। স্বামী যেখানে সকালের খিচুড়িই খাবেন, সেখানে তিনি কী করে একা ওসব ভাল খাবার খান? সন্ধ্যায় সুমনের বাবা ফিরলে একসঙ্গে খাবেন।
সুমনের বাবা রোস্ট-পোলাও জাতীয় খাবার খুব পছন্দ করতেন। বেচারা স্বল্প বেতনের চাকরি করতেন বলে, কোনও উপলক্ষ ছাড়া সাধারণত ওসব খাবার জুটত না। ছেলেও হয়েছে বাবার মত। রোস্ট-পোলাও খুব পছন্দ করে। সেদিন দুপুরে তিনি ঠাণ্ডা খিচুড়ি খেলেও, সুমনকে চার পিস রোস্টের এক পিস দিয়ে পোলাও খাইয়েছিলেন।
সন্ধ্যার পর পরই শুরু হয় সুমনের বাবার ফেরার অপেক্ষা। সুলতানা বেগম জানতেন সুমনের বাবার ফিরতে কমপক্ষে ন’টা-সোয়া ন’টা বেজে যায়। তারপরও তিনি গভীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকেন। এই বুঝি ফিরবেন। দিনটা অন্যান্য দিনের মত নয়! বিবাহ বার্ষিকীর দিন! নিশ্চয়ই আগে-ভাগেই ফিরবেন। এখনই দরজায় টুক-টুক শব্দ তুলে ক্লান্ত গলায় ডাকবেন, ‘সুলতানা, ও, সুলতানা, দরজা খোলো। সুমন, বাবা, ঘুমিয়ে পড়েছিস? তোর মাকে দরজা খুলতে বল।’
প্রাইভেট কোম্পানির চাকরিতে প্রচুর খাটাত। যে টাকা বেতন দিত তার তিনগুণ খাটিয়ে মারত। লোকটা অফিস থেকে ফিরলে মুখের দিকে তাকানো যেত না। যেন সারাদিন রোদে পুড়ে রিকশা চালিয়ে ফিরতেন।
ন’টা বেজে যায়। আর দেরি নেই, এখনই সুমনের বাবা এসে পড়বেন, এই ভেবে সুলতানা বেগম খাবার গরম করতে লেগে পড়েন। সেই সঙ্গে সালাদ বানাবার জন্য টমেটো-ক্ষীরা কুচাতে থাকেন।
সালাদ বানানো এবং খাবার গরম করা হয়ে গেলে টেবিলে সাজিয়েও ফেলেন। ঘড়ির কাঁটাও সাড়ে ন’টার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু সুমনের বাবা ফেরেন না।
সুলতানা বেগম চিন্তিত মুখে ভাবেন, কী হলো লোকটার-এত দেরি করছেন কেন? আকাশের অবস্থা ভাল নয়। ঘন-ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। যে কোনও মুহূর্তে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতে পারে। ঝড়বৃষ্টি শুরু হবার আগে ভালয়- ভালয় মানুষটা এসে পৌঁছতে পারবেন তো?
ওদিকে ছোট্ট সুমন ঘুমানোর জন্য ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু করে। না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়তে চায়। সুলতানা বেগম ছেলেকে জাগিয়ে রাখার জন্য মন ভোলানো বিভিন্ন কথা বলতে থাকেন, ‘সুমন, বাবা, আমার লক্ষ্মী সোনা, এখনই তোর বাবা চলে আসবে। তখন সবাই মিলে একসঙ্গে খাব। খেয়েই ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়ব। তুই তোর বাবার হাতে খেতে ভালবাসিস না, বল? তোর বাবা নিশ্চয়ই তোর জন্য কোনও খেলনা কিনতে গিয়ে দেরি করছে। দেখতে চাস না সেই খেলনা? তুই একটা প্লাস্টিকের কচ্ছপ আর ডাইনোসরের কথা বলছিলি মনে আছে? নিশ্চয়ই তোর বারা আজ তোর জন্যে কচ্ছপ আর ডাইনোসর নিয়ে আসবে। একটু সবুর কর না, বাবা!’