‘যদি বলি এক পাগল সন্ন্যাসীর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি, বিশ্বাস করবে?’ হাসল আর্থার। মেয়েটা শ্রাগ করে ঘুরে দাঁড়াল। আপনি যেমন আচরণ করছেন, বিশ্বাস না করে উপায় কি? ভাবল সে।
‘কাল দেখা হবে,’ বলল আর্থার। বেরিয়ে গেল কাঁধে ব্যাগটা ফেলে। তার মাথায় এখনও ব্যান্ডেজ বাঁধা, কালশিটে পড়া চোখ ঢেকে রেখেছে সানগ্লাসে।
.
ফ্রান্সের ওপর দিয়ে, দক্ষিণ-পুবে উড়ে চলেছে ছোট জেটটা, আর্থার আলতো আঙুল ছোঁয়াল ব্যান্ডেজে। ফুলে আছে সেলাই। হালকা একটা দাগ থাকবে, বলেছে ডাক্তার। তবে চিন্তার কিছু নেই। এতে ওর চেহারা বিকৃত দেখাবে না। বরং মনের দাগটা মুছে যাবার সম্ভাবনা কম।
পকেট থেকে টেলিগ্রামটা বের করল আর্থার, চোখ বুলাল আবার। আকুল আবেদন ফুটে উঠেছে লেখায়। মারা যাচ্ছেন প্রীস্ট, আর্থারের সাথে দেখা করতে চাইছেন। হাসপাতালের ঠিকানাটা দেখল আর্থার। খুঁজে পেতে আশা করি কষ্ট হবে না।
আউটার রানওয়েতে ল্যান্ড করল প্লেন। ফর্মালিটিজ সেরে দ্রুত বেরিয়ে এল আর্থার। ওর সেক্রেটারি রোম অফিসকে বলে আগেই ভাড়া করে রেখেছে গাড়ি। ওটাতে উঠে বসল সে।
ঘণ্টা দুই লাগল গ্রামটাতে পৌঁছুতে। হাসপাতালটা রাস্তা থেকে দেখা যায় না, অনেক ভেতরে। সাইনবোর্ড দেখে অবাক হলো। মেন্টাল হসপিটাল! প্রবেশ পথে গাড়ি থামাল আর্থার। হেলান দিল সীটে। বৃথা সময় অপচয় করছে না তো? ভাবছে ও। কাজ ফেলে এসেছে একটা পাগলের প্রলাপ শুনতে? কিন্তু যখন চলেই এসেছে:: দীর্ঘশ্বাস ফেলে একতলা বিল্ডিংটাতে ঢুকে পড়ল আর্থার। হঠাৎ শিরশির করে উঠল গা। ওরা যদি ওকে পাগল সাজিয়ে আটকে রাখে? কেউ জানে না আর্থার এখানে আসবে। কেউ ওর খোঁজ পাবে না… দূর, কি আবোলতাবোল ভাবছি, নিজেকে চোখ রাঙাল আর্থার। হাসল রিসেপশনিস্টের দিকে তাকিয়ে। জানাল ফাদার ডি কার্লোর সাথে দেখা করতে এসেছে। রিসেপশনিস্ট অপেক্ষা করতে বলল ওকে। এক মিনিট পর, এক যুবককে দেখা গেল। এ সেই ব্রাদার ডেভিড। ওকে দেখে অনুতাপ জাগল আর্থারের মনে। লোকটার কথায় যদি ওই সময় কান দিত, হয়তো এতগুলো প্রাণকে অকালে ঝরে যেতে হত না…
‘আসার জন্যে ধন্যবাদ,’ হাত বাড়িয়ে দিল সন্ন্যাসী, তারপর আর্থারকে জড়িয়ে ধরল বুকে। আলিঙ্গন শেষে পিছিয়ে গেল আর্থার, লক্ষ করল লোকটার চোখে জল।
‘কেমন আছেন উনি?’
‘শীঘ্রি উনি শান্তির জগতে চলে যাবেন,’ বলল ডেভিড। আর্থারের হাত ধরে পা বাড়াল করিডরের উদ্দেশে।
‘কিন্তু উনি এখানে কেন? একটা পা–’ শব্দটা বেরুতে চাইল না মুখ থেকে।
‘পাগলাগারদে?’ বলল ডেভিড। ‘ওরা ওনাকে পাগল ঠাউরেছে। তিনি বারবার পৃথিবী ধ্বংসের কথা বলতেন, ইংল্যান্ডে মেসেঞ্জার পাঠানোর জন্যে লোক খুঁজতেন। আমরা বলেছিলাম মঠেই ওনার দেখাশোনা করতে পারব। কিন্তু ওরা জোর করে…’
আর্থার জিজ্ঞেস করতে চাইছিল ‘ওরা’ কারা, কিন্তু কিছু বলল না। নীরবে অনুসরণ করল সন্ন্যাসীকে।
সিঁড়ি বেয়ে একটা বেযমেন্ট করিডরে নেমে এল দু’জনে। বাতাসটা বেশ ঠাণ্ডা, আর আলো খুব কম। যেন দর্শনার্থীরা পরিষ্কার ভাবে কিছু দেখতে না পারে তার জন্যে এমন ব্যবস্থা করা হয়েছে।
করিডরের শেষ মাথায় একটা দরজায় টোকা দিল ডেভিড। সবুজ ইউনিফর্ম পরা পুরুষ নার্স উঁকি দিল, মাথা দুলিয়ে সরে দাঁড়াল এক পাশে। কার্বোলিক এসিডের গন্ধ ধাক্কা মারল আর্থারের নাকে।
সন্ন্যাসীর পিছু পিছু ভেতরে ঢুকল সে। ছোট একটা ঘর, সেল বললেই মানায়-একটা কট. একটা ওয়াশবেসিন আর একটা টয়লেট বোল। জানালার দিকে চোখ চলে গেল আর্থারের। গরাদ নেই। তবে এত সরু যে ফাঁক গলে ঢোকা বা বেরুনো মুশকিল।
কটে শোয়া শরীরটা নড়ে উঠল, একটা হাত তুলল।
‘মি. আর্থার?’ চিঁচিঁ গলায় জানতে চাইলেন মানুষটা।
ঝুঁকে হাড্ডিসার হাতটা নিজের হাতে তুলে নিল আর্থার। ডি কার্লোর মুখে মাংসের বালাই নেই, হাঁ টা কালো একটা গর্তের মত। ঠাণ্ডা চামড়ার স্পর্শে শিউরে উঠল আর্থার। এই মানুষটাই পৃথিবীকে রক্ষা করতে চেয়েছেন, এই হতভাগা পাগল মানুষটা। আর তার পুরস্কার কিনা জুটেছে পাগলাগারদে শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গোণার মধ্যে।
‘বসুন, মি. আর্থার।
করিডর থেকে একটা চেয়ার নিয়ে এল সন্ন্যাসী।
‘আপনার অবস্থা দেখে সত্যি খুব খারাপ লাগছে,’ বিছানায় বসল আর্থার।
মাথা নাড়লেন ডি কার্লো। ‘আপনার সহানুভূতি তাদের জন্যে জমা রাখুন যাদের এটা সত্যি দরকার।’ এক মুহূর্ত দু’জনে তাকিয়ে রইলেন পরস্পরের দিকে।
‘আপনি তো ধার্মিক মানুষ নন, মি. আর্থার?’
মাথা নেড়ে সায় দিল আর্থার।
‘তাহলে এখানে এলেন কেন?’
শ্রাগ করল আর্থার। ‘আপনার নোট আর চিঠিগুলো পড়েছি। তবে কোন যুক্তি খুঁজে পাইনি—’
‘আমরা যুক্তি নিয়ে কথাও বলছি না।’
‘ভূত-প্রেতে আমার বিশ্বাস নেই।’
‘তাহলে, আবার প্রশ্নটা করি, কেন এলেন?’
‘হয়তো করুণা করে।
ডানে-বামে মাথা নাড়লেন ডি কার্লো।
‘তাহলে কৌতূহল।
হাসলেন ডি কার্লো। জবাবটা স্বার্থপরের মত হয়ে গেছে, ভাবল আর্থার। মুখ নিচু করে মেঝেতে তাকাল ও।
‘আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছি,’ স্বীকারোক্তির মত শোনাল কথাটা। তবে কথাটা বলে স্বস্তি বোধ করছে সে।
‘আমার দিকে তাকান,’ বললেন ডি কার্লো।
আর্থার তাকাল ফাদারের দিকে। সে পাগল হয়ে যাবার ভয়ের কথা বলছে আরেক পাগল আখ্যা পাওয়া লোকের কাছে। কি অদ্ভুত!