পর্দার দিকে তাকিয়ে আছেন ফাদার। বাদামী মাটি দেখা যাচ্ছে। ডায়াল পাঁচ ফুটে অ্যাডজাস্ট করতে দৃশ্যটা পরিষ্কার হয়ে ফুটল। কাদা মাটির এক্স-রে বলা যায় ওটাকে। চকোলেট বারের মত দেখতে।
স্ল্যাবের দিকে এগোলেন ডুলান, কবরের পাশে দাঁড়ালেন। লাশের প্রস্তরখচিত নামের ওপর পা রেখে। আবার চোখ ফেরালেন পর্দায়। মাটির চেহারা বদলে গেছে। মাটির সাথে এবার নুড়ি উঠছে। যন্ত্রটা দুই হাঁটুর মাঝখানে রেখে ডায়াল ঘোরাতে শুরু করলেন। শর্ট রেঞ্জের ফোকাস করছেন। তাঁর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল পর্দায় কফিনের মেহগনি কাঠের ঢাকনা দেখে। অজান্তে হাত উঠে এল বুকে, ক্রুশ আঁকলেন। ডুলান শুনেছেন মৃত্যুর পরেও লাশের চুল আর নখ বাড়তে থাকে। যদি দেখেন মুখ ভর্তি দাড়ি আর হাতে মস্ত বাঁকানো নখ নিয়ে লাশটা তাঁর দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে! তখন?
চোখ বুজে ফেললেন ডুলান, ভয়ে ভয়ে ডায়ালের দিকে হাত বাড়ালেন। জোর করে আবার চোখ মেললেন। পর্দায় পাথরের আস্তরণ দেখা যাচ্ছে। ভুরু কুঁচকে গেল তাঁর। ডায়াল নিয়ে নড়াচড়া শুরু করলেন: দু’ইঞ্চি ওপরে, আরও পাথর; চার ইঞ্চি নিচে, কফিনের মেঝে দেখা গেল; আট ইঞ্চি ওপরে, পর্দা হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেল, তারপর দুটো শব্দ ঝলসে উঠল ওখানে: AIR VENT.
দ্রুত নড়ে উঠলেন ডুলান, স্ল্যাবের চারপাশে বারবার স্ক্যানার ঘুরিয়ে দেখলেন। কিন্তু পাথর ছাড়া কিছু চোখে পড়ল না। ডেমিয়েন থর্নের কবর সম্পূর্ণ খালি। মেশিন বন্ধ করে দিলেন ঝট্ করে, হতভম্বের মত তাকিয়ে রইলেন পাথরে খোদাই করা নামের দিকে। ডানে-বামে মাথা নাড়তে নাড়তে সরে এলেন স্ল্যাবের সামনে থেকে।
‘আমার এখন দরকার, জোরে জোরে বললেন তিনি, ‘বড়সড় একটা ড্রিঙ্ক।’
.
সমাধি থেকে অনেক দূরে, পুবে, ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে চ্যাপেলে, বাবার হাত মুঠো করে ধরে রেখেছে, নীরবে ঠোঁট নড়ছে তার; কপাল থেকে ঘাম বেয়ে নামছে, ঢুকে যাচ্ছে চোখে, ঘাম পড়ছে হাতে, ডেমিয়েন থর্নের হাত ভিজে গেল। ছেলেটার চেহারা কুঁচকে আছে মনোসংযোগের ভঙ্গিতে, কপালে শিরা ফুটে উঠেছে টানটান তারের মত, ওদিকে পেরিফোর্ডের জঙ্গলে প্রকাণ্ডদেহী কুকুরটা মুখ তুলে চাইল পশ্চিম আকাশের দিকে, তারপর ক্রুদ্ধ গর্জন ছাড়ল…
.
নর্থ শিকাগো সেমিট্রি’র কাছের একটা বার, লিন্ডসে’তে ঢুকলেন ফাদার টমাস ডুলান। ঢকঢক করে মদ গিললেন। বারটেন্ডার তাঁকে দেখল বার দুই ফোন বুদে ঢুকতে। দুইবারই হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে এলেন। রোমে খবরটা পৌঁছুনো খুব জরুরী। কিন্তু লাইন পাচ্ছে না অপারেটর। তিন বারের বার লাইন পাওয়া গেল। কিন্তু অপারেটর জানাল অপর পক্ষ ফোন ধরছে না। টেনশনে ফাদারের হার্টবিট বেড়ে গেল। অবশেষে ফোন ধরল ওয়াল্টার। ডুলান তাকে ঘটনাটা বললেন। ধন্যবাদ দিল ওয়াল্টার। কণ্ঠ শুনে বোঝা গেল ঘটনা শুনে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছে।
ফাদারের দায়িত্ব শেষ। এবার তিনি নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি ফিরতে পারবেন।
রাস্তায় নামার সাথে সাথে বাতাসের ঝাপটা খেলেন ডুলান। আবহাওয়া বদলে গেছে। লেকের পানিতে ঢেউ উঠছে, পুবের আকাশে জমতে শুরু করেছে মেঘ। ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে যাচ্ছে চাঁদের দিকে। গোরস্থানের গেট খুললেন ডুলান। বারটেন্ডার বলেছে কাছের ক্যাব স্ট্যান্ডে যাবার এদিক দিয়ে শর্টকাট রাস্তা আছে। ইন্ডিয়ানদের রাইফেল ধরার মত মেশিনটা বুকের সাথে চেপে হোঁচট খেতে খেতে এগোলেন ফাদার। বেশি মদ খাওয়া হয়ে গেছে, ভাবছেন তিনি। মাথা ঝিমঝিম করছে। থুথু আসছে। মদ পানে অভ্যস্ত নন ডুলান।
থর্ন সমাধির দিকে এক নজর তাকালেন ফাদার। মনে হলো কিছু একটা নড়াচড়া করছে ওখানে, হলুদ দুটো বিন্দুও যেন দেখতে পেলেন এক মুহূর্তের জন্যে। গা শিরশির করে উঠল তাঁর, দ্রুত হাঁটতে লাগলেন। বাতাসের বেগ বেড়েছে। মাথা নিচু করে হাঁটতে হচ্ছে তাঁকে। কিন্তু ঠিকমত হাঁটতে পারছেন না। টলছেন। হঠাৎ একটা পাথুরে ফলকের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। মৃদু গুঞ্জন শুনে তাকালেন মেশিনের দিকে। হাঁ করে দেখলেন চালু হয়ে গেছে ডিটেকটর। অন্ধের মত হাতড়ে বেড়ালেন সুইচ, বন্ধ করবেন যন্ত্র। কিন্তু খুঁজে পেলেন না সুইচ। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন পর্দার দিকে। কবর খুঁড়ছে ডিটেকটর, একটা খুলি দাঁত বের করে হাসল ফাদারের দিকে চেয়ে। চোখ মিটমিট করলেন ডুলান, ঢোক গিললেন, তারপর সিধে হয়েই দৌড় দিলেন মেশিনটাকে পেছনে টানতে টানতে।
এক দৌড়ে গেটে পৌঁছে যাবেন ভেবেছিলেন ডুলান। কিন্তু শক্তি পাচ্ছেন না শরীরে। খকখক কেশে উঠলেন, দেবদূতের একটা মূর্তির গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। বমি আসছে তাঁর। তেতো ঢেকুর উঠছে। থুক্ করে তেতো থুথু ফেললেন মাটিতে। গুঙিয়ে উঠলেন ডুলান, জামার আস্তিনে মুখ মুছলেন। ডিটেকটরের অবিরাম গুঞ্জনে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকালেন পর্দার দিকে।
এবারেরটা প্রাণীর কঙ্কাল। কুকুর, বা হায়েনা হতে পারে, শেয়াল হওয়াও বিচিত্র নয়। সিধে হয়েছেন তিনি, মনে হলো কঙ্কালটার হাড়গুলো নড়ে উঠল, পেছনের পা জোড়া লাথি ছুঁড়ছে। ওদিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না তাঁর, তারপরও সম্মোহিতের মত চেয়ে রইলেন। বাতাসে বোটকা একটা গন্ধ। ডুলান রুমাল বের করে নাক চাপা দিলেন।