.
প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়ে নাদিয়াদের বাসায় ঢুকল আনোয়ার। আনোয়ারকে দেখে চমকে উঠল নাদিয়া। ‘কোথায় গিয়েছিলেন আপনি? নিজেকে কী মনে করেন?’
আনোয়ার উত্তর না দিয়ে হাসল। মেয়েটার রাগ দেখতে ভাল লাগছে। ও শুধু বলল, ‘একটু জরুরি কাজ পড়ে গিয়েছিল।’
‘আপনি কি রেহানাদের গ্রামে গিয়েছিলেন?’ –
‘হ্যাঁ।’
‘মানুষের বিপদ নিয়ে আপনি খুব ভাবেন, না?’
‘চেষ্টা করি। সবসময় তো আর পারি না।’
‘আমাকে তো আপনার মানুষ মনে হয় না।’
‘ছি-ছি, এসব কী বলছ, নাদিয়া?’
‘তা হলে কেন আমার বিপদে পাশে থাকছেন না?’
‘তোমার কী বিপদ?’
‘আপনি চোখের সামনে না থাকলে আমার…’
‘তোমার…’
‘কিছু না।’ আরেক ঘরে চলে গেল নাদিয়া।
নার্গিস জাহানও অনেক বকাবকি করলেন আনোয়ারকে।
নাদিয়া ছাড়া কেউ জানল না আনোয়ার কোথায় গিয়েছিল।
.
রেহানার প্রচণ্ড জ্বর। সব ধরনের টেস্ট করা হয়েছে, কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায়নি কোনও রোগ।
রেহানা আবার চলে গেছে ঘোরের মধ্যে। সে এখন নিয়মিত সেই নগ্ন মানুষটাকে দেখতে পায়। মাঝে-মাঝে জ্ঞানও পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে। তখন মুখ দিয়ে বেরোতে থাকে ফেনা। সেজানের কেন জানি মনে হচ্ছে, আর বাঁচবে না রেহানা। কষ্টে যেন ফেটে যাচ্ছে তার বুক।
ঘরের ভিতর প্রায়ই অস্বাভাবিক সব কাণ্ড চলছে, যা সেজানকে আরও বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। সেদিন হঠাৎ রান্নাঘরে আগুন লেগে গেল। ভাগ্যিস আগেভাগে দেখেছিল রেহানা। নতুবা ঘটত বড় অঘটন। ঘরের ভিতর প্রায়ই ফেটে যাচ্ছে বাল্ব। কোনও কারণ ছাড়াই যখন-তখন হচ্ছে তীব্র বাতাস। এ ছাড়া, সেদিন দুটো মরা বিড়ালের বাচ্চা পাওয়া গেছে খাটের তলে। আর টায়ার পোড়া গন্ধটা তো আছেই।
এসব ঘটনা বাদেও, দু’দিন আগে এই বাড়িতে আরও একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে। পাশের ফ্ল্যাটের রহমত আলী হঠাৎই মারা গেছে। পচন ধরেছিল তার শরীরে। ফুলে ঢোল হয়ে গিয়েছিল পেট। বিশ্রী কিছু পোকা বাসা বেঁধেছিল শরীরে। কয়েকদিন তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করে অবশেষে মারা গেছে রহমত আলী।
সবকিছু মিলিয়ে খুব অসহায় লাগছে সেজানের। সে খবর পাঠিয়ে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে রেহানার মামীকে। তিনি রেহানার অবস্থা দেখে অস্থির হয়ে পড়েছেন ভয়ে।
আট
রাত এগারোটার একটু বেশি বাজে। ঘুমিয়ে পড়েছে নাদিয়াদের বাসার সবাই। এখন ছাদে বসে আছে আনোয়ার। ছাদের দরজা বন্ধ করে রেখেছে, যাতে হুট করে কেউ আসতে না পারে ছাদে। এই বাড়ির আশপাশে খুব বেশি লোকবসতি নেই। সেটাও বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে আনোয়ারকে।
চুপচাপ হতে শুরু করেছে চারদিক। আজ বেশ জেঁকে বসেছে শীতটা। গায়ে সাদা পোশাক আনোয়ারের। শরীরে শীতের বাড়তি কোনও পোশাক নেই। বেশ কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস রয়েছে আশপাশে: লোহার শিক, মাটির ঢেলা ইত্যাদি। ধ্যানমগ্ন আনোয়ার প্রথমে নানাধরনের দোয়া-দরূদ পড়ে শান্ত করল মনকে। এরপর জ্বালল তিনটা বড় মোমবাতি। বুকের মধ্যে অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে ওর। সেটা ভয় নয়, শঙ্কা নয়, অন্য কিছু। মোমবাতির আলোতেই সূরা জিন পাঠ করা শুরু করল আনোয়ার এক মনে।
অন্য কোনও দিকে নজর নেই ওর। আস্তে-আস্তে পড়ছে, কিন্তু মনে হচ্ছে, বহুদূর ছড়িয়ে পড়ছে সূরা পাঠের আওয়াজ। নড়ছে গাছের পাতা। মোমবাতির শিখা কাঁপছে মৃদু বাতাসে। যেন অন্য জগতে চলে যাচ্ছে আনোয়ার। কাঁপছে গলা।
চলছে সূরা তেলাওয়াত। চলছে…চলছে…
সূরা তেলাওয়াতের একদম শেষ দিকে হঠাৎ শুরু হলো দমকা বাতাস। একবারে নিভে গেল দুটো মোমবাতি। সেদিকে একটু তাকাল আনোয়ার। তারপর আবার শুরু করল পড়তে। দ্রুত পায়ে ছাদে হাঁটাহাঁটি শুরু করল কেউ। হঠাৎ টায়ার পোড়া গন্ধ পেল আনোয়ার। তারপর কেউ যেন প্রচণ্ড আক্রোশে কিছু ছুঁড়ে দিল ওর দিকে। একটা মরা বিড়াল দেখল আনোয়ার। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল বিড়ালটার নাড়ি-ভুঁড়ি।
এরপর আনোয়ারের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল কেউ। এখন একটা মোমবাতি জ্বলছে ছাদে। অল্প আলোতে এক মানুষকে দেখতে পেল আনোয়ার। শরীরে তার অসংখ্য গর্ত। সেই গর্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে সাদা-সাদা পোকা। এমন কী চোখের জায়গাটাতেও কিলবিল করছে অসংখ্য পোকা।
খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘হুজুর, আস্সালামু আলাইকুম।’
‘ওয়ালাইকুম আস্সালাম।’
‘হুজুর, আপনি আমাকে আবার ডেকেছেন কেন?’
ভয়-ভয় লাগছে আনোয়ারের। কেন জানি মনে হচ্ছে, হেরে যাবে সে। ওর জন্য অপেক্ষা করছে নির্মম পরিণতি।
আনোয়ার বলল, ‘তুই কেন এসেছিস রেহানার কাছে?’
‘হুজুর, আমি বলেছিলাম, ও বিয়ে করলে ওকে আমি ছাড়ব না।’
‘আমি এখন বলছি, ওকে ছেড়ে চিরতরে চলে যা।’
খান্নাস মাথা নাড়ল। সে যাবে না। কিছুতেই না।
‘খান্নাস, তুই বড়জোর মেরে ফেলবি রেহানাকে। কিন্তু আমিও তোকে ছাড়ব না, সেটা মাথায় রাখিস। আমি আবার তোকে আটকে রাখব। তুই কি তাই চাস?’
‘না-না। আমি মুক্তি চাই। মুক্তি চাই।’
‘তা হলে নিজ দেশে ফিরে যা।’
‘আমি রেহানার কাছে থাকব, হুজুর।’
‘না, তা হবে না। কিছুতেই না,’ কঠোর গলায় বলল আনোয়ার। জোরে- জোরে বেশ কিছু সূরার আয়াত পড়তে লাগল সে। এরপর খান্নাসের দিকে ছুঁড়ে দিল একটা লোহার শিক।
খান্নাস চিৎকার করে উঠল। ‘হুজুর, আমার কষ্ট হচ্ছে!’
‘তুই যদি না যাস, তবে আরও কষ্ট পেতে হবে তোকে।’