.
রেহানার ডায়রিটা বন্ধ করল নাদিয়া। বুকের মধ্যে চেপে থাকা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এল তার।
ডায়রিটা নিয়ে আনোয়ারের ঘরে ঢুকল নাদিয়া।
শুয়ে-শুয়ে বই পড়ছিল আনোয়ার। তার শরীর এখনও পুরোপুরি ভাল হয়নি শুয়ে-বসে থাকতে-থাকতে শরীরে যেন মরিচা ধরে গেছে। তবুও সব হাসিমুখে সহ্য করছে আনোয়ার। কারণ সামনে অনেকগুলো জায়গায় ঘুরতে হবে তার। শরীরটা তাই পুরোপুরি ঠিক করা দরকার।
নাদিয়া বলল, ‘আনোয়ার ভাই, আপনার খুব বোরিং সময় কাটছে, না?’
‘না, বোরিং না। আমি আসলে সেবা-যত্ন পেয়ে অভ্যস্ত না। তোমাদের সেবা-যত্নে যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছি। মনে হচ্ছে পরিবার বিষয়টা খারাপ না।’
‘বিয়ে-টিয়ে নিয়ে ভাবছেন নাকি?’
‘একটু-আধটু ভাবছি।’
‘আপনি তো রহস্য-প্রেমিক। কোনও মানবীর প্রেমে কি আপনি পড়বেন?’
‘পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি রহস্য তো লুকিয়ে আছে মানবীর মধ্যেই।’
‘ভাল বলেছেন। আপনি এত সুন্দর করে কথা বলতে পারেন, আগে জানতাম না।’
‘সম্ভবত রূপবতী তরুণীর কাছাকাছি থাকলে সব ছেলেই সুন্দর করে কথা বলার চেষ্টা করে।’
‘আমি রূপবতী? শুনতে ভাল লাগল।’ হেসে ফেলল নাদিয়া।
হাসিতে যোগ দিল আনোয়ারও।
কয়েক সেকেণ্ড পর মুখটা একটু গম্ভীর করে বলল নাদিয়া, ‘আনোয়ার ভাই, এটা রেহানা নামের এক মেয়ের ডায়রি। আমাকে পড়তে দিয়েছে। আমি চাই ডায়রিটা আপনিও পড়ুন। আপনি তো অনেক অতিপ্রাকৃত, ভৌতিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। তাই পুরো ঘটনাটা জেনে আপনার প্রতিক্রিয়া কী হয়, জানতে ইচ্ছা করছে। আপনি নিশ্চয় বিষয়টা আরও সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবেন।’
‘অন্যের ডায়রি অনুমতি ছাড়া পড়া কি ঠিক হবে?’
‘আমি রেহানাকে বুঝিয়ে বলব। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, ওর এই ভয়াবহ সমস্যার কোনও সমাধান আপনি দিতে পারবেন।’
‘আচ্ছা, ডায়রিটা রেখে যাও।’
ডায়রিটা রেখে চলে গেল নাদিয়া।
ডায়রির ছোট ওই লেখাটা পড়তে আনোয়ারের লাগল পঁয়ত্রিশ মিনিট। সে আরও দুইবার মন দিয়ে লেখাটা পড়ল। তারপর ব্যস্ত ভঙ্গিতে পরতে লাগল পোশাক।
সুযোগ বুঝে আস্তে-আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল আনোয়ার।
যেতে চায় সে রেহানাদের গ্রামে। ঢাকা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। গাড়িতে চার-পাঁচ ঘণ্টা লাগার কথা।
আনোয়ার একটা চিরকুট রেখে গেছে।
নাদিয়া,
জরুরি দরকারে ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। চিন্তা কোরো না, দ্রুতই ফিরে আসব। রেহানা মেয়েটার পাশে থেকো। সম্ভব হলে আমার জন্য অপেক্ষা কোরো।
চিরকুটটা যখন পেল নাদিয়া, তখন আনোয়ার গাবতলি বাসস্ট্যাণ্ডে। আনোয়ারকে ফোন করার চেষ্টা করে দেখল, সে ফোনটা বাসায় রেখে গেছে। চোখের কোণে পানি জমল নাদিয়ার। কাঁদতে-কাঁদতে চিরকুটটা বুকে জড়িয়ে ধরল। বিড়বিড় করে বলল, ‘আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব। সবসময় অপেক্ষা করব।’
ছয়
রূপগঞ্জ যখন পৌঁছাল তখন পার হয়ে গেছে সন্ধ্যা। লোকমান ফকিরের বাড়িটা খুঁজে বের করল আনোয়ার। লোকমান ফকির বেশ অসুস্থ। আনোয়ারকে দেখে তিনি বললেন, ‘আপনি কে?’
‘আমার নাম আনোয়ার। আমি ঢাকায় থাকি।’
‘আমার কাছে কী মনে করে?’
‘আমি আসলে রেহানার ব্যাপারটা নিয়ে আপনার সাথে কথা বলতে চাই,’ কিছুটা ইতস্তত করে বলল আনোয়ার।
রেহানার বিষয়ে? আপনি কথা বলতে এসেছেন!!!’
‘হ্যাঁ। সম্ভবত জিন খান্নাস রেহানার কাছে ফিরে এসেছে।’
দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন লোকমান ফকির, ‘আমি জানতাম ও ফিরে আসবে। রেহানার বিয়ে হলে খান্নাস ওকে ছাড়বে না। আমি ওর মামাকে আগেই সাবধান করেছিলাম। ওরা আমার কথা শুনল না।’
‘রেহানার এখন কী হবে তা হলে?’
‘খান্নাস মেয়েটা এবং তার স্বামীকে মেরে ফেলবে।’
‘আপনি ওদের বাঁচান।’
‘এটা আমার পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়। … আপনি রেহানার কে হন?’
‘আমি আসলে রেহানার আপন কেউ নই। অলৌকিক অদ্ভুত বিষয়গুলোর প্রতি প্রবল আকর্ষণ আছে আমার। সেই আগ্রহ থেকেই রেহানার বিষয়টা সম্পর্কে জানতে পেরেছি। সবকিছু জানার পর রেহানার জন্য কিছু করতে ইচ্ছা হয়েছে।’
‘আপনার চোখ দেখেই আমি অবশ্য বুঝেছি, আপনার মধ্যে আল্লাহ্ প্রদত্ত কিছু শক্তি রয়েছে। আপনার মনোবল অনেক শক্ত। তবে খান্নাসের কাছ থেকে রেহানাকে রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব।’
‘কোনও উপায়ই কি নেই রেহানাকে রক্ষার?’
মুখটা অনেক গম্ভীর হয়ে গেল লোকমান ফকিরের। আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘জিন বিষয়ে কি আপনার কোনও ধারণা আছে?’
‘খুব বেশি কিছু জানি না। আমাকে কি পুরো বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলবেন?’
‘হুম, শুনুন তা হলে। জিন আগুন দিয়ে তৈরি। আল্লাহ্ পাক পবিত্র কোরআন মাজিদে সূরা আল হিজরের ২৭ নাম্বার আয়াতে বলেছেন: ‘আর ইতঃপূর্বে জিনকে সৃষ্টি করেছি উত্তপ্ত অগ্নিশিখা থেকে।’ দুষ্ট এবং মন্দ জিনকে আরবিতে বলে ইফরীত। এরা মানুষের ক্ষতি করার জন্য ব্যতিব্যস্ত থাকে। কোনও মানুষেরই উচিত না জিনদের ব্যবহার করে কোনও কাজ সমাধা করা। এতে তাদের সাহস ও ঔদ্ধত্য বেড়ে যায়। তখন তারা মনে করতে শুরু করে, তারা মানুষের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। আল্লাহ্ পাকও কোরআন মাজিদে এ সম্পর্কে মানুষকে সাবধান করেছেন। সূরা আল জিনের ছয় নাম্বার আয়াতে আল্লাহ্ পাক বলেছেন: ‘আর নিশ্চয় কতিপয় মানুষ আশ্রয় নিত কতিপয় জিনের, ফলে তারা তাদের অহঙ্কার বাড়িয়ে দিয়েছিল।’ খান্নাস আমার অধীনস্থ ছিল। সত্যি বলতে মন্দ জিনকে অধীনে রাখতে অনেক শক্তি ও সাহসের প্রয়োজন হয়। আলহামদুলিল্লাহ, তার সবই আমার আছে। আমি কখনও খান্নাসের কাছে কোনও বিষয়ে সাহায্য চাইনি। কারণ, এতে করে বেড়ে যেত ওর সাহস। হয়তো একসময় আমার ক্ষতি করারও চেষ্টা করত। ওকে আমি নির্দিষ্ট একটা এলাকার মধ্যে বন্দি করে রেখেছিলাম। খান্নাস তাই পূর্ণ মুক্তি পাওয়ার জন্য ফন্দি করে। একদিন রাতে রেহানাকে একা পেয়ে যায়। রেহানাকে ভয় দেখায়। কেউ ভয় পেলে ইফরীতদের শক্তি বহুগুণে বেড়ে যায়। ভীত মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে ওরা।