বিড়বিড় করে বলেন রফিক সাদি, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, মা। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘আমার ছেলে কি ফিরে আসবে না, বাবা?’
‘নিশ্চয়ই ফিরে আসবে, মা।’
‘ওকে তুমি ভুল বুঝো না, বাবা। ছোট বাচ্চা তো।’
.
যেমন হুট করে চলে গিয়েছিল রাইয়ান, তেমনি হুট করেই ফিরল। এই কয়েক দিনে শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। পোশাক বিবর্ণ। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্ত শুকিয়ে কালো। নির্বিকার ভঙ্গিতে রফিক সাদির বাসায় ঢুকে পড়ল সে। রাইয়ানকে পেয়ে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল নুযহাত। কিন্তু এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিল রাইয়ান। এক দৌড়ে চলে গেল নিজের রুমে। রাইয়ান ফিরে আসার খবর পেয়ে তড়িঘড়ি করে রাফিক সাদির বাড়িতে এল আনোয়ার।
সারাদিন দরজা বন্ধ করে থাকল রাইয়ান। দরজা খুলল বিকেল মিলিয়ে যাওয়ার পর। ভালভাবে গোসল করে, পরেছে নতুন পোশাক। ওকে দেখে মনে হলো না, ওর মধ্যে অশুভ কিছু আছে। আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল রাইয়ান, ‘তুমি ঠিকই বলেছিলে। মানুষই শ্রেষ্ঠ। `মাথাটা নিচু করে নিল ও। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। ‘এই ক’দিনে আমি আমার বাবাকে চিনে ফেলেছি। সে আমার কষ্টের সময় আমাকে এতটুকু সাহায্য করেনি। তার মনে হিংসা, ক্রোধ, লোভ আর মিথ্যার বাস। সেখানে মমতা বলে কিছু নেই। পুরো পৃথিবীতে রাজত্ব করতে চায় আমার মাধ্যমে।’
বড় করে দম নিয়ে রাইয়ান বলল, ‘তোমাদের মাঝে এসে বদলাতে বাধ্য হয়েছি। সেই পিশাচকে জানিয়ে দিয়েছি, আমি মানুষ হয়েই বাঁচতে চাই, পিশাচ হয়ে নয়। আমার এ মনোভাব জেনে আমাকে পরিত্যাগ করেছে সে।’
স্বস্তির রেখা দেখা দিল আনোয়ার, নুযহাতের মুখে। দৌড়ে গিয়ে রাইয়ানকে জড়িয়ে ধরল ওর মা। কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘আমি তোকে কানাডা নিয়ে যাব, বাবা। তুই সব ভুলে যাবি। আমি তোকে সবসময় বুকে জড়িয়ে ধরে রাখব।’
‘না।’
‘মানে?’
‘আমি পিশাচের বশ্যতা স্বীকার করেছি, এক অর্থে তার সাধনা করেছি। তার মাধ্যমে মৃত থেকে হয়েছি জীবিত। এখন আমাকে পরিত্যাগ করেছে সে। এর মানে কি জানো?’
‘কী?’
‘আগামী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমি মারা যাব।’
‘মানে?’
‘যদি জীবিত-মৃতের এই খেলাটা না খেলতাম, যদি সবকিছু পিশাচের উদ্দেশে সঁপে না দিতাম, তবে আজ তোমাদের মাঝে বেঁচে থাকতাম।
‘তোমার কিছু হবে না, রাইয়ান,’ জোর গলায় বলল আনোয়ার, ‘আমরা তোমার সাথে আছি।’
মৃদু হেসে রাইয়ান বলল, ‘দেখছ না আমার শরীর কেমন খারাপ হয়ে গেছে? এবার সত্যিকারভাবে মরব। আর কোনও শক্তি আমাকে বাঁচাতে পারবে না।’
‘এসব কী বলছিস, বাবা? কেউ তোকে মারতে পারবে না! কেউ না!’ ডুকরে কেঁদে উঠল নুযহাত।
আনোয়ার বলল, ‘রাইয়ান, তোমার বেঁচে থাকাটা জরুরি। তুমি আবার পিশাচের বশ্যতা স্বীকার করো। তাতে অন্তত বাঁচবে। আমরা অন্যভাবে মোকাবেলা করব পিশাচের।’
‘না,’ আস্তে করে মাথা নাড়ল রাইয়ান। ‘পিশাচের অধীনে বাঁচার চেয়ে স্বাধীন মানুষ হয়ে মরা অনেক ভাল। আমি আর পিশাচের আরাধনা করব না। একটু বিরতি নিয়ে অনুরোধের সুরে বলল রাইয়ান, ‘তোমরা একটা কাজ করবে?’
‘বলো,’ নরম সুরে বলল আনোয়ার।
‘তোমরা মাঝে-মাঝে যাবে আমার কবরের কাছে। যেমন মানুষ মানুষের জন্য স্রষ্টার কাছে দোয়া করে, আমার জন্যে তাই করবে তোমরাও।’ আনোয়ারের মুখ থেকে কোনও কথা বের হলো না। কান্নায় ভেঙে পড়ল নুযহাত। পরম মমতায় রাইয়ানের কপালে হাত রাখলেন রফিক সাদি।
শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে রাইয়ানের। জীবনে প্রথমবারের মত নুযহাতকে ‘মা’ বলে ডাকল। ‘মা, এই ছবিটা তোমার জন্য।’ পকেট থেকে বের করে একটা ফোটো নুযহাতের হাতে দিল রাইয়ান।
শুরু হয়েছে ওর শরীরে তীব্র খিঁচুনি। নুযহাত শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরলেও এতটুকু কমল না ওর কাঁপুনি। ক্রমশ কালো হয়ে গেল রাইয়ান। মনে হলো, শরীরের মধ্য দিয়ে নড়াচড়া করছে কিছু। উথাল-পাতাল হাওয়া যেন ওকে উড়িয়ে নেবে। একটু পর থামল সব, নিথর হয়ে রইল রাইয়ান।
ওর দেয়া ছবিটা নুযহাতের কাছ থেকে নিল আনোয়ার।
ছবিতে তার মায়ের কোলে শুয়ে আছে একটা বাচ্চা। ছবির নিচে লিখেছে রাইয়ান, ‘মা, এত দেরি করে এলে কেন?’
মুহূর্তেই চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল আনোয়ারের। মনে পড়ল ওর নিজের মা-র কথা।
***