রাইয়ানকে বোঝানোর চেষ্টা করল আনোয়ারও। বলল, ‘ক্ষমতাই সবকিছুর শেষ কথা নয়। তোমাকে মিথ্যা শিখিয়েছে পিশাচ। তোমার মাধ্যমে এই পৃথিবীতে রাজত্ব করতে চায় সে।’
‘আনোয়ার, মেরে ফেলার সময় হয়েছে তোকে। সবটুকু কষ্ট দিয়ে তোকে মারব আমি। তোর জন্য বহুদূরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন আমার বাবা।’
‘রাইয়ান, তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, পুরো বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করো।
‘তুই তো মন্ত্র-তন্ত্র করে হারিয়ে দিয়েছিলি আমার বাবাকে। এবার পারলে মন্ত্র পাঠ করে তাড়িয়ে দে আমাকে!’
‘তুমি মানুষ, পিশাচকে তাড়ানোর মন্ত্র তোমার জন্য কাজ করবে না। মন্ত্র দিয়ে তাড়ানো যায় না মানুষকে।’
‘আমি মানুষ নই, পিশাচ। আমি পিশাচের সন্তান। আমার বাবা আমাকে অনেক ভালবাসেন। আমি আমার বাবাকে ভালবাসি।’
‘ঠিক আছে, চলো, হয়ে যাক পরীক্ষা।’
‘কী পরীক্ষা, আনোয়ার?’
‘তোমার বাবা যদি তোমাকে এতই ভালবাসে, তবে তাকে ডাকো। তার সাহস থাকলে এখানে আসুক। এসে বলুক, তুমি তার সন্তান।’
‘তুই কি ভেবেছিস আমার বাবা আসবেন না? আমার বাবা ‘অবশ্যই আসবেন। আর আমার বাবা এলে ছিঁড়ে নেবেন তোর কলিজা। তোকে খণ্ড-খণ্ড করে প্রতিশোধ নেবেন।’
‘না, রাইয়ান, সে আসবে না। মানুষ শ্রেষ্ঠ, পিশাচ অনেক নিম্নশ্রেণীর সত্তা। সে আমার সামনে আসার সাহস পাবে না। সে আমাকে ভয় পায়। কারণ, আগেরবার আমার কাছে পরাজিত হয়েছিল।’
চোখ বন্ধ করে তার বাবাকে ডাকতে থাকল রাইয়ান। বুকের মধ্যে কেউ যেন ঢাকের মত শব্দ করছে আনোয়ারের। সে অনেক বড় একটা ঝুঁকি নিয়েছে। এক ধরনের জুয়া খেলেছে। সত্যি যদি চলে আসে পিশাচটা, অনায়াসেই দু’জন মিলে মেরে ফেলবে ওকে।
বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেল, চোখ বন্ধ করে আছে আনোয়ারও। চেষ্টা করছে মনকে শান্ত করতে। পুরো ঘরে পিনপতন নীরবতা। কয়েক মিনিট পর চোখ মেলে তাকাল রাইয়ান। আনোয়ার লক্ষ করল, কেমন যেন একটা হতভম্ব ভাব ফুটে উঠেছে রাইয়ানের চোখে।
‘আমার বাবা এখন আসবেন না,’ রাইয়ান বলল, ‘তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন তোমাকে মেরে ফেলতে।’ রাইয়ান আবারও তুমি করে বলা শুরু করেছে আনোয়ারকে, এটা ভাল লক্ষণ।
আনোয়ার বলল, ‘রাইয়ান, ওই পিশাচ নিজ স্বার্থে তোমাকে ভুল জিনিস শিখিয়েছে। এতদিন তার কথা বিশ্বাস করেছ। এবার আমাদের কথা বিশ্বাস করে দেখো। মানুষ হয়ে মানুষকে হত্যা করা যায় না। আমি তোমাকে হত্যা করতে পারিনি। আমি জানি, তুমিও আমাকে হত্যা করতে পারবে না।’
নুযহাত বলল, ‘বাবা, আমার বুকে আয়।’
কয়েক কদম পিছিয়ে গেল রাইয়ান। চিৎকার করে বলল, ‘না-না! আমার কাছে আসবে না! আমি সব ধ্বংস করে দেব! সব!’ বলতে-বলতে যেন ঝড় উঠল পুরো বাড়িতে। তুলোর মত কাঁপতে লাগল সবকিছু। তাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে গেল নুযহাত ও আনোয়ার। কিছু একটা আঘাত করল ওদের দু’জনকে, প্রচণ্ড গতিতে। একটা অদৃশ্য হাত গলা চেপে ধরেছে নুযহাতের কোনওভাবেই তার নিস্তার নেই। তবু বলার চেষ্টা করল নুযহাত, ‘বাবা রে, আমি মনে হয় মরে যাব! আমার কাছে আয়, একবার তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিই!’
আনোয়ার চিৎকার করে বলল, ‘রাইয়ান, ভুল করছ, মানুষকে বিশ্বাস করো, পিশাচকে নয়। ভুল করছ, রাইয়ান। ভুল…’
অপ্রকৃতিস্থের মত নিজের মাথা ঝাঁকাতে লাগল রাইয়ান। মনে হচ্ছে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে তার। ঘরের মধ্যে বেগ বাড়তে থাকে বাতাসের। ধুপ-ধুপ শব্দ করে এ-মাথা ও-মাথা দৌড়াচ্ছে কেউ।
এখনও সেই হাত চেপে ধরে রেখেছে নুযহাতের গলা। বহুকষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল সে, ‘রাইয়ান…আমার ছেলে…আমার ছেলে! আমি তার মা!’ বলতে-বলতে শরীর এলিয়ে পড়ল নুযহাতের। মনে হলো সে আর বেঁচে নেই। এমন সময় হুট করেই শান্ত হয়ে এল বাড়ির পরিবেশটা। কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাইয়ান।
আনোয়ার বলল, ‘রাইয়ান, তোমার মা মারা যাচ্ছে! বাইরে যেতে দাও আমাদের! হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে তাকে! আমাদের বিশ্বাস করো!’
কিছু না বলে দৌড়ে বাসার বাইরে চলে গেল রাইয়ান।
দেরি না করে নুযহাতকে হাসপাতালে নিয়ে গেল আনোয়ার।
সাতাশ
প্রাণে বেঁচে গেছে নুযহাত। তবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার শ্বাসনালী। এ ছাড়া, টানা এক সপ্তাহ ক্রমাগত শারীরিক আঘাতে বিপর্যস্ত। বেশ কিছুদিন বিশ্রাম ও নিয়ম মেনে চলতে হবে। পাঁচদিন পরে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেয়া হলো নুযহাতকে। আগের চেয়ে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন রফিক সাদিও। মেয়েকে নিয়ে দ্রুত কানাডা ফিরতে চাইছেন তিনি।
কিন্তু রাজি হচ্ছে না নুযহাত, ছেলেকে রেখে কানাডা যেতে রাজি নয়।
বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল রাইয়ান, এরপর আর কোনও খোঁজ নেই তার। নিজের বাসায় ফিরে গেছে আনোয়ার। প্রায় প্রতিদিনই রফিক সাদির বাসায় আসে সে। কারও মুখেই কোনও কথা থাকে না, গম্ভীর মুখে বসে থাকে সবাই। দিন এবং রাতের বেশ খানিকটা সময় রাইয়ানকে খুঁজে বেড়ায় আনোয়ার। রহস্যের কথা বাদ দিলেও এক ধরনের মায়া অনুভব করে ও বাচ্চাটার প্রতি।
সারাক্ষণ কাঁদে নুযহাত
মেয়ের ক্রমাগত কান্না কষ্ট দিচ্ছে রফিক সাদিকেও। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। কাঁদতে-কাঁদতে বলে নুযহাত, ‘বাবা, কোথায় হারিয়ে গেল আমার ছেলে?’