আণ্টিকে সান্ত্বনা দিয়ে ফোন রেখে বিড়বিড় করে বলল আনোয়ার, ‘রাইয়ান!’ এরপর যোগাযোগ করতে চাইল কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে। কিন্তু ডেড হয়ে গেছে ল্যাণ্ড ফোন। কাজ করল না মোবাইল ফোনও।
সাধনা – ২৫
পঁচিশ
শারীরিক এবং মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছেন রফিক সাদি। এদিকে বেশিরভাগ সময় নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে রাখছে রাইয়ান।
রফিক সাদির ঘরে ঢুকে চমকে উঠল আনোয়ার। কাঁপা গলায় বলল, ‘আপনার মুখে এত আঁচড়ের চিহ্ন কীসের?’
‘কাল রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম।’
‘কী দুঃস্বপ্ন?’
‘দেখি, প্রবল আক্রোশে বড়-বড় নখ দিয়ে আমার মুখে আঁচড় দিচ্ছে একটা ভয়ঙ্কর প্রাণী। আর বলছে, ‘আমি তোকে মেরে ফেলব, অনেক কষ্ট দিয়ে মারব।’ ঘুম ভাঙার পর দেখলাম মুখের বিভিন্ন জায়গা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।’ কেঁদে ফেললেন রফিক সাদি।
বাবার পাশে বসে আছে নুযহাত। আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এসব কী হচ্ছে, একটু বুঝিয়ে বলবেন? আমি আজ বাসা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মনে হলো অদৃশ্য কেউ শক্ত করে চেপে ধরেছে আমার হাত। এমন কী খুলতে পারলাম না গেটের তালাটাও। ডেড হয়ে পড়ে আছে সব মোবাইল ফোন। এদিকে বাবার এ অবস্থা! রীতিমত ভয় লাগছে আমার!’
সহজে আর এই বাড়ি থেকে বেরোতে পারবে না, বুঝে গেছে আনোয়ার। বাধা দেবে রাইয়ান। সে ক্ষমতা তার আছে। রফিক সাদির দিকে তাকিয়ে বলল আনোয়ার, ‘আমার মনে হয়, সব খুলে বলা উচিত নুযহাতকে।’
হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না রফিক সাদি। নুযহাতকে ধীরে-ধীরে সব খুলে বলতে লাগল আনোয়ার। শুনছে নুযহাত, বারবার কেঁপে উঠছে তার শরীর আনোয়ারের সব কথা শেষ হলেও যেন জগতে ফিরতে পারল না মেয়েটা। কিছুক্ষণ পর ধরে রাখতে পারল না চোখের পানি। কাতর গলায় বলল, ‘বাবা, তুমি কেন মিথ্যা বলেছিলে আমাকে? তুমি বলেছিলে মারা গেছে আমার সন্তান। তখন মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ছিলাম, সেই সুযোগে উল্টাপাল্টা বুঝিয়েছিলে তুমি আমাকে।’
‘মা, যা করেছি, তোর ভালর জন্যই করেছি। এই ছেলেটা সাক্ষাৎ পশু।’
‘খবরদার, বাবা! আমার ছেলেকে নিয়ে খারাপ কিছু বলবে না!’
‘যে অল্প বয়স থেকেই মানুষকে ভয়ানকভাবে কষ্ট দেয়, যে পিশাচের কথা অক্ষরে-অক্ষরে মেনে চলে, যে মরে গিয়ে আবারও জীবিত হয়, তাকে তুই ছেলে বলছিস?’
‘আমার ছেলে কোনও পশু নয়, সে পড়েছে একটা পশুর কবলে।’
মাথা নেড়ে বলল আনোয়ার, ‘আপনার কথা অনেকাংশে ঠিক। মানুষের শক্তি পিশাচের চেয়ে অনেক বেশি। দেখুন, চার বছর বয়স পর্যন্ত কোনও ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটায়নি রাইয়ান। কারণ ততদিন পর্যন্ত সে নিজেকে ভেবে এসেছে মানুষ। কিন্তু যখনই জানল, মুবিন চৌধুরী, মরিয়ম বেগম তার মা-বাবা নয়, তখনই সুযোগের সদ্ব্যবহার করল পিশাচটা। নানাভাবে প্রভাবিত করতে লাগল রাইয়ানকে, তার পিশাচ-সত্তাকে জাগিয়ে তুলল পুরোপুরি।’
ভাঙা গলায় বলল নুযহাত, ‘আমি অত কিছু বুঝি না, আমি আমার ছেলের কাছে যাব।’
‘আপনার কথা ভাল লেগেছে আমার,’ আনোয়ার বলল, ‘রাইয়ান অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। মন্ত্র, তাবিজ বা এ ধরনের অন্য কিছু কোনও ফল বয়ে আনবে না। বাঁচতে চাইলে আমাদের একটাই উপায় আছে।’
‘কী উপায়?’
‘জাগিয়ে তুলতে হবে রাইয়ানের মানবীয় সত্তাকে।’
সেটা কীভাবে সম্ভব?’
‘রাইয়ানকে উজাড় করে দিতে হবে আপনার সব মমতা। সে আঘাত করলেও, খারাপ কথা বললেও আমাদেরকে সহ্য করতে হবে। সে যতই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মত কথা বলুক না কেন, তার মধ্যে আছে শিশুর মন, সেটা জাগিয়ে তুলতে হবে। সেক্ষেত্রে রাইয়ানকে আর কোনও কাজে লাগাতে পারবে না পিশাচটা।’
উঠে দাঁড়িয়ে বলল নুযহাত, ‘আমি আমার ছেলেকে মমতা দেব না কেন? ওকে আমি বুকের মধ্যে আগলে রাখব।’
‘কাজটা অনেক কঠিন। তবু আমাদের চেষ্টা করতে হবে।’
ছাব্বিশ
রাইয়ানের হাতে একটা সাদা বিড়াল। হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ওটার মাথায়। আনোয়ার এবং নুযহাতকে দেখে ফুটে উঠল তার কপালের রগ। ক্রোধমাখা কণ্ঠে বলল, ‘তোরা আমার কাছে এসেছিস কেন?’
‘আমি তোমার মা, রাইয়ান, বাবা,’ হাত বাড়িয়ে বলল নুযহাত। ‘হারামজাদী, চুপ কর! আমার কোনও মা নেই!’
নিজের আবেগ সামলে অনেক কষ্টে বলল নুযহাত, ‘আমি তোমার মা। আমি তোমাকে গর্ভে ধরেছি।’
‘বাঁচার জন্য আমার সাথে আলগা পিরিত করতে এসেছিস? বাঁচবি না, বাঁচবি না, তোরা কেউ বাঁচবি না!’
‘তুমি চাইলে আমাকে মেরে ফেলো, কোনও সমস্যা নেই। সন্তানের জন্য জীবন দিতে মা সবসময় প্রস্তুত।’
‘আয়! তোর হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়ে নিই! দেখি তুই কত ভালবাসিস আমাকে!’
‘ছি, বাবা। বাজে কথা বলতে হয় না।’
একটানা অনেকগুলো অশ্লীল গালি দিল রাইয়ান। কানে হাত দিল নুযহাত। এখানেই থেমে থাকল না রাইয়ান। এক টানে আলাদা করে ফেলল বিড়ালটার ধড় থেকে মাথা। রক্ত মেখে হয়ে উঠল দেহ রঞ্জিত। জোরে হাসতে লাগল রাইয়ান। রক্ত তার ভাল লাগে।
সন্তানের জন্য সম্ভবত সবকিছু করতে পারেন মা। নানাভাবে রাইয়ানের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করল নুযহাত, বোঝানোর চেষ্টা করল তাকে। একদিন পার হলো, দু’দিন পার হলো, দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল এক সপ্তাহ। তাকে আঘাত করল রাইয়ান, অশ্লীল কথা বলল, কখনও দিল ভয়ঙ্কর কষ্ট, তবু লক্ষ্য থেকে এক চুল পিছু হটল না নুযহাত। কারণ সে জানে, তার ছেলেকে ভাল করার একমাত্র উপায় মমতা ঢেলে দেয়া।