এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন রফিক সাদি। ধপাস করে সোফায় শুয়ে পড়লেন।
আনোয়ার বের হওয়া মাত্রই রফিক সাদির রুমে ঢুকল রাইয়ান, যেন এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল দাঁড়িয়ে। কিছু বলার চেষ্টা করলেন রফিক সাদি। কিন্তু মুখ দিয়ে বের হলো না কোনও শব্দ। এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল রাইয়ান। বাঘ যেমন শিকারের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, ওর দৃষ্টিও অনেকটা সেরকম। রফিক সাদির মনে হলো, রাইয়ানের চোখ দুটো জ্বলছে এবং গলা দিয়ে বের হচ্ছে ফোঁস-ফোঁস আওয়াজ। ভয় পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন রফিক সাদি। হঠাৎ লক্ষ করলেন, অসাড় হয়ে আসছে তাঁর হাত-পা। ঘর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। মনে হচ্ছে, যেন প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে ভেতরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কেউ। দুষ্টু হাসি রাইয়ানের মুখে।
দ্রুত ঘরের সাথে লাগোয়া বাথরুমে ঢুকলেন রফিক সাদি। ছেলেটার ওই ভয়ঙ্কর দৃষ্টি বেশিক্ষণ সহ্য করা সম্ভব নয়। রফিক সাদির মনে হলো, তিনি ছাড়াও আরও কেউ আছে বাথরুমে। কোনও বিশেষ কারণ ছাড়াই ঘুরে উঠল মাথাটা, পড়ে গেলেন তিনি বাথরুমের মেঝেতে। প্রচণ্ড ব্যথা পেলেন কোমরে, হাতে এবং পায়ে। চোখের সামনে দেখতে পেলেন রাইয়ানকে। একদিকে কাত হয়ে আছে তার মাথা, মুখ দিয়ে ঝরছে লালা। বহুদিন আগে তিনি ঝমঝম কুঠিতে দেখেছিলেন জয়নালের মধ্যে এমন ভঙ্গি। শাওয়ারটা ছেড়ে দিল কেউ। রফিক সাদির মনে হচ্ছে আর বাঁচবেন না তিনি।
চব্বিশ
রাইয়ানের ঘরে ঢুকল আনোয়ার। মেঝেতে বসে আছে রাইয়ান, মাথায় কালো একটা কাপড় বাঁধা। টকটকে লাল চোখ। একদিকে কাত হয়ে আছে মাথাটা। মুখ দিয়ে ঝরছে লালা। ডাকল আনোয়ার, ‘রাইয়ান।’
মাথাটা সোজা করে তাকাল রাইয়ান। চুষে নিল মুখের লালাটুকু। হিসহিসে গলায় বলল, ‘বল, কী বলবি?’
‘আমাকে তুই করে বলছ?’
‘তোর খুব আঁতে ঘা লেগেছে নাকি, জানোয়ার?’
‘তুমি কী চাও?’
‘আমি সবকিছু চাই এবং আমার বাবা আমাকে সবকিছু দেবেন।’
কে তোমার বাবা?’
‘মনে হচ্ছে তুই এখনও ফিডার খাস, কিছু বুঝতে পারছিস না?’
‘রফিক সাদিকে কেন বাথরুমে ফেলে দিলে? কেন আমাদের এই বাড়ি থেকে বের হতে দিচ্ছ না?’
‘আমি প্রতিশোধ নেব। খুব ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ।’ চোখে-মুখে ক্রোধের চিহ্ন ফুটে উঠল রাইয়ানের। ‘তোরা আমার এবং আমার বাবার সাথে যে অন্যায় করেছিস, তার বদলা আমাকে নিতেই হবে। রফিক সাদি, তোর বন্ধু শাহেদ চৌধুরী, নুযহাত এবং জানোয়ার, মানে তুই কাউকে ছাড়ব না।’
‘তুমি ভুল করছ, রাইয়ান। আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলাম, হত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলাম।’ দৃঢ় কণ্ঠে আনোয়ার বলল, ‘তোমার বিরুদ্ধে কিছু করিনি। এমন কী তোমার মধ্যে ভয়ঙ্কর কিছু লুকিয়ে আছে জেনেও তোমাকে হত্যা করা হয়নি।’
‘হ্যাঁ, জানি। তুই আমাকে সুযোগ পেয়েও মেরে ফেলিসনি। এজন্য তোকে সবার শেষে মারব। আগে বাকিগুলোকে শেষ করব।’
‘শেষ করবে?’
‘হ্যাঁ। সবটুকু কষ্ট দিয়ে শেষ করব। তিলে-তিলে যন্ত্রণা দিয়ে শেষ করব।’
দাঁত বের করে হাসল রাইয়ান। অস্বাভাবিক লম্বা এবং সূচাল দাঁত দেখলে বুকটা আঁতকে উঠবে যে কারও।
‘আমার বাবা প্রায়ই স্বপ্নে আসেন। নানা দিকনির্দেশনা দেন। বাবার সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছি মৃত্যুকে। আমি দুইবার মরে, বেঁচে উঠেছি। এখন আমি এবং আমার বাবা না চাইলে কেউ মারতে পারবে না আমাকে।’ হাত উঁচু করে চিৎকার করে বলল রাইয়ান, ‘আমি নিষ্ঠুরতা দেখাতে চাই, মানুষকে কষ্ট দিতে চাই, সত্যিকারের পিশাচ হতে চাই। আমার বাবার মত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে চাই। আমি আর আমার বাবা শাসন করব পুরো পৃথিবী। আমার বাবা স্বপ্নে এবং ধ্যানে বারবার দেখা দেন। তিনি প্রতিনিয়ত পথ দেখাচ্ছেন আমাকে। গত দুই বছর ধরে ক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছি আমি আমার।’
শীতল গলায় বলল আনোয়ার, ‘তোমার বাবা একটা নির্বোধ, ভীতু।’
‘কী বললি?’ বিকৃত হয়ে গেল রাইয়ানের মুখটা।
‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছি। তোমার বাবা মানুষের সামনে আসতে ভয় পায়, তার ক্ষমতা এখন শূন্যের কোঠায়। তাই তোমাকে কাজে লাগিয়ে আবার ক্ষমতাশালী হতে চায় সে।’
‘মিথ্যা! মিথ্যা বলছিস তুই! আমার বাবাকে তুই চিনি না!’ লাল হয়ে গেছে রাইয়ানের মুখ। দেখে মনে হলো পুড়ে গেছে মুখের খানিকটা অংশ। লাফ দিয়ে উঠেই আনোয়ারকে সজোরে চড় বসাল রাইয়ান। তাল সামলাতে না পেরে সামনের টেবিলে গিয়ে পড়ল আনোয়ার। মেঝেতে পড়ে গেল ফুলদানিটা। কয়েক মুহূর্ত চোখে-মুখে অন্ধকার দেখল আনোয়ার। রক্তের লোনা স্বাদ পেল মুখের ভেতর। মুখে বরফ ঘষছে আনোয়ার। বেশ ফুলে উঠেছে মুখটা। এদিকে শয্যাশায়ী রফিক সাদিও। তার বন্ধু ডিবি পুলিস অফিসার শাহেদকে ফোন দিল আনোয়ার। আগেরবার অনেক সাহায্য করেছিল শাহেদ, এবারও প্রয়োজন তার সাহায্য।
ফোনটা ধরল না শাহেদ, ধরল ওর মা। তিনি কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বললেন, ‘গতকাল অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে শাহেদের। শরীরের চারটা হাড় ভেঙেছে। মাথায় ও পেয়েছে গুরুতর আঘাত।’
শ্বাসটা আটকে রেখে বলল আনোয়ার, ‘কীভাবে হলো অ্যাক্সিডেন্ট?’
‘আমরা কিছুই জানি না। গতকাল শাহেদকে গুলশান দুইয়ের গোল চত্বরের সামনে পড়ে থাকতে দেখে পুলিস। তারপর নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।’