ভিতরের উত্তেজনা বুঝতে দিল না আনোয়ার, স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘খুবই ভাল।’
‘তোমার সাথে দেখা হয়েছিল ছয় বছর আগে। এরপর আর দেশে আসা হয়নি, দেখাও হয়নি। নুযহাতকে বিয়ে দিয়েছি। নুযহাত খুব সুখে আছে। বাপ- মেয়ে দশদিনের জন্য চলে এলাম দেশের টানে।’
‘খুব ভাল করেছেন।’
‘অবশ্যই বাসায় আসবে। আমরা খুব খুশি হব তুমি কয়েকটা দিন আমাদের সঙ্গে থাকলে। কারণ, তুমি আমাদের অনেক আপন একজন। তোমার ঋণের কথা কখনও ভোলা সম্ভব নয়।
ফোনে নুযহাতও কথা বলল, ‘আনোয়ার ভাই, আপনাকে কয়েকটা দিন আমাদের বাসায় থাকতেই হবে। কোনও না শুনব না।’
আনোয়ার রাজি না হয়ে পারল না। ঠিক করল রাইয়ানকেও নিয়ে যাবে ওই বাসায়। কেন যেন ওর মন বলছে, ওই বাসাতেই রাইয়ান বিষয়ে লুকিয়ে আছে কোনও সমাধান।
সেই পুরানো স্মৃতি মনে পড়ল আনোয়ারের। নুযহাতের কথা, রফিক সাদির কথা, ঝমঝম কুঠির কথা, জয়নালের কথা, পিশাচের কথা।
দুপুরের দিকে খেয়ার সাথে দেখা হলো ওর। বুঝল, গতকাল যা দেখেছে, সবই ভ্রান্তি, চোখের ভুল। রাইয়ান একবারও জিজ্ঞেস করল না কোথায় তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সব জানে।
রাইয়ানকে নিয়ে রফিক সাদির বাসায় যখন পৌছাল আনোয়ার, সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রফিক সাদি বুকে জড়িয়ে ধরলেন আনোয়ারকে। কিছুক্ষণ কুশলাদি বিনিময়ে পার হলো। রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে সরু চোখে বললেন রফিক সাদি,
‘এই ছেলেটি কে?’
তাঁর কানের কাছে মুখ এনে বলল আনোয়ার, ‘আপনাকে সব বলব। এখন কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।’ কথা ঘুরিয়ে উঁচু গলায় বলল আনোয়ার, ‘আপনি বলেছেন, তাই আপনার বাসায় কয়েকদিন থাকতে এলাম। কোন্ রুমে থাকব আমরা?’
.
আনোয়ার এবং রাইয়ানকে দুটো আলাদা রুমে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন রফিক সাদি। তাঁকে আলাদা রুমে ডেকে নিয়ে বলল আনোয়ার, ‘এই ছেলেটি কে, আপনি জানেন?’
‘কে, বলো তো! ওর দিকে তাকিয়েই বুকের ভিতরটা কেমন যেন কেঁপে উঠেছে।’
‘উত্তরটা শুনতে আপনার ভাল লাগবে না।’
‘তবু বলো। আমি শুনতে চাই।’
রফিক সাদিকে বলল আনোয়ার, ‘এই ছেলেটি আপনার নাতি।’
‘আমার নাতি? কী বলছ এসব?!’
‘হ্যাঁ।’
‘আমার কোনও নাতি নেই,’ মাথা দোলাতে-দোলাতে বললেন রফিক সাদি। কাজ করছে না মাথা। এতদিন পর দেশে এসে এ কী শুনছেন?
আবারও বলল আনোয়ার, ‘আপনি অস্বীকার করলেও সত্য সত্যই। এই ছেলেটি নুযহাতের সন্তান।’
‘না-না! নুযহাতের কোনও সন্তান নেই!
‘আপনি জোর দিয়ে বললেই তো সত্য কখনও মিথ্যা হবে না। নুযহাতের সাথে ছেলেটার চেহারার মিল নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন?’
‘এ নুযহাতের নয়, পিশাচের সন্তান,’ প্রচণ্ড রাগে চিৎকার করে বললেন রফিক সাদি, ‘তোমাকে বলেছিলাম বাচ্চাটিকে মেরে ফেলতে! তুমি ওই পিশাচটাকে মেরে ফেলোনি কেন?’
আনোয়ার বলল, ‘আমি পারিনি মারতে। মানুষ হয়ে হত্যা করা যায় না অন্য মানুষকে।’
‘বাহ! ভালই করেছ! আমার দেশে আসাই ভুল হয়েছে। এই আবর্জনা বেঁচে আছে জানলে কখনও ফিরতাম না।’
‘একটা এতিমখানায় রেখে এসেছিলাম রাইয়ানকে। কয়েক মাস পর ওখান থেকে একটি পরিবার ওকে দত্তক নেয়।’
‘তা হলে এতদিন পর তুমি কীভাবে একে খুঁজে বের করলে? সেই পরিবারের পরিচয়েই তো এর বড় হওয়ার কথা।’
‘রাইয়ানকে ঘিরে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সমস্যার পিছনে ছুটতে গিয়েই জেনে ফেলেছি ওর আসল পরিচয়।’
‘কী সমস্যা?’
‘আপনাকে পরে সব বলব।’
‘এই বাচ্চা যেখানেই যাবে, সৃষ্টি করবে সমস্যা। তুমি একবার আমাদের বাঁচিয়েছ। কিন্তু এবার তোমার ভুলেই আমরা মারা পড়ব।’
‘আমি কোনও ভুল করিনি। সেই মুহূর্তে ওটিই ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত। আগেই বলেছি এই বাচ্চাটির মধ্যে আছে মানব-সত্তা এবং পিশাচ-সত্তা-দুইই। চার বছর বয়স পর্যন্ত একে নিয়ে খুব সমস্যা হয়নি। হ্যাঁ, হয়তো ছিল কিছু অস্বাভাবিকতা। কিন্তু সেসব বড় কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু চার বছর বয়সে প্রথম জানল, সে অন্য কারও সন্তান। সেই দুর্বল মুহূর্তে জেগে উঠল তার পিশাচ-সত্তা। তার সাথে যোগাযোগ শুরু করল পিশাচ। তাকে বোঝাতে লাগল, চাইলে এই পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রাণী হতে পারে সে। প্রায়ই ধ্যানমগ্ন হয়ে তার পিশাচ বাবার সাথে যোগাযোগ করত রাইয়ান। নানা ধরনের শক্তির চর্চাও হতো সেই মুহূর্তে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল মারা গিয়েও পুনরায় বেঁচে ওঠার বিষয়টি। তার শারীরবৃত্তীয় কাজগুলো বন্ধ করে দিতে পারে রাইয়ান, আবার সচলও করতে পারে ধীরে- ধীরে। মুনি-ঋষিদের মধ্যে এই বিষয়টা নিয়ে প্রচলিত আছে অনেক গল্প। শরীরকে এমন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ইয়োগা, ধ্যান, মেডিটেশন করতেন ঋষিরা। রাইয়ানও তার পিশাচ বাবার বশ্যতা স্বীকার করে ধ্যানের মাধ্যমে আত্মস্থ করেছিল এই বিষয়টি। আসলে আমরা তাড়িয়ে দিয়েছিলাম পিশাচকে। তাকে একবার তাড়ালে পুনরায় ফিরতে অনেক সমস্যা হয় তার। তাই কাজে লাগাচ্ছে সে রাইয়ানকে। ধীরে-ধীরে ওর মাধ্যমে ফিরে আসতে চায় সে।’
অন্যদিকে তাকিয়ে বলল আনোয়ার, ‘দেরি হয়ে গেছে। এখন আর সবকিছু আমাদের হাতে নেই। চাইলেও বাড়ি ছেড়ে যেতে পারব না আমি। এমন কী রাইয়ান না চাইলে এ বাসা থেকে বের হতে পারবেন না আপনিও।’ কথা শেষ করে নিজের ঘরে চলে এল আনোয়ার।