‘কেউ ইচ্ছাকৃত এ কাজ করতে পারে?’ জিজ্ঞেস করল আনোয়ার।
‘মানে?’
‘মানে, কেউ ইচ্ছাকৃত মৃত্যুবরণ করে আবারও জীবিত হতে পারে?’
‘বিষয়টা হাস্যকর শোনালেও উত্তরটা হচ্ছে: হ্যাঁ, পারে। অনেক মুনি, ঋষি, সাধুরা সাধনার মাধ্যমে নিজ শারীরবৃত্তীয় কাজকে বন্ধ করে দিতে পারে সাময়িকভাবে। এতে আপাতদৃষ্টিতে তারা মৃত মানুষের মত হয়ে যায়, আবার নির্দিষ্ট সময় পর সচল হয়ে ওঠে তাদের শরীর। ডা. রাশেদ মুখে হাত বোলাতে- বোলাতে বলল, ‘অনেকটা সাপ বা ব্যাঙের শীতযাপনের সাথে তুলনা করা যায় এর। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এটি বিশেষ এক ধরনের ক্ষমতা।’
‘কীভাবে অর্জন করা যায় এই ক্ষমতা?’
‘ধ্যান ও বিভিন্ন যোগ সাধনার মাধ্যমে অর্জন করা যায়। তবে প্রকৃতি প্রদত্ত কিছু বিষয়েরও প্রয়োজন হয়। সবাই এ কাজ করতে পারলে তো পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন পড়ে যেত। এত সহজ নয় বিষয়টা।’
‘আপনি খুব সহজ করে বুঝিয়ে বলেন, রাশেদ ভাই। অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলাম।’
‘তুমি কি এখনও ভূত, প্রেত, রহস্য নিয়ে পড়ে আছ?’ কৌতুকের সুরে জিজ্ঞেস করল ডা. রাশেদ।
উত্তর না দিয়ে হাসল আনোয়ার। আবার বলল ডা. রাশেদ, ‘তুমিই অবশ্য ভাল আছ। সারাদেশে ঘুরে বেড়াও, অ্যাডভেঞ্চার করো। কতই না আনন্দ। আর আমাদের নিজেদের জন্য সময় বলতে কিছু নেই।’
‘এবার আপনাকে নিয়ে একটা অ্যাডভেঞ্চারে যাব।’
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ। আগে হাতে একটা কাজ আছে, ওটা শেষ করে নিই, তারপর বিস্তারিত বলব আপনাকে।’
উঠে দাঁড়াল আনোয়ার।
ডা. রাশেদ বলল, ‘এত তাড়া কীসের? ডিনার করে যাও।’
‘না, ভাইয়া, একটু কাজ আছে। পরে আবার আসব।’
বাইশ
ঘড়িতে রাত দশটা বেজে বিশ মিনিট। একরাশ ক্লান্তি নিয়ে বাসায় ফিরেছে আনোয়ার। ভাল লাগছে না শরীরটা। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। রাইয়ানের দিকে দৃষ্টি গেল। এক মনে টিভি দেখছে ছেলেটা।
আনোয়ারকে দেখে রাইয়ান বলল, ‘কী, আমার ব্যাপারে সব খোঁজ পেলে?’
জবাব দিল না আনোয়ার।
‘তোমার হাত থেকে রক্ত পড়ছে কেন?’ টিভির দিকে তাকিয়েই বলল রাইয়ান।
অবাক হয়ে নিজের ডান হাতের দিকে তাকাল আনোয়ার। সেখান থেকে এক নাগাড়ে ঝরছে রক্ত। ক্রমেই বাড়ছে ব্যথা। ক্ষতটা দেখে মনে হচ্ছে, ওর হাতের কয়েক জায়গায় ধারাল ছুরি দিয়ে পৌঁচ দিয়েছে কেউ। অথচ এতক্ষণ ক্ষতটা লক্ষই করেনি আনোয়ার। হাসছে রাইয়ান। আনোয়ারের মনে হচ্ছে, সে পরিচিত এই হাসির সাথে। এমন বিশ্রীভাবে হাসতে পারে না কোনও বাচ্চা ছেলে। আচ্ছা, ওর হাতের ক্ষতের সাথে কোনও যোগসূত্র নেই তো রাইয়ানের? হাতে অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে ছাদে চলে গেল আনোয়ার। আজ রাতে নিজের ঘরে ছাদের চিলেকোঠায় থাকার ইচ্ছা ওর। কী যেন মনে করে তালা মেরে রাখল ছাদের দরজাটা।
রাতে হঠাৎ ভেঙে গেল আনোয়ারের ঘুম। চারপাশে গাঢ় অন্ধকার। পিপাসা পেয়েছে খুব। পানি ও আলোর পিপাসা এলোমেলো করে দিচ্ছে মনোজগৎকে। বিছানায় উঠে বসল। তখনই শুনতে পেল একটা মেয়ের কান্নার শব্দ।
আনোয়ার বলল, ‘কে…কে?’
থেমে গেল মেয়েটার কান্না। একটু পর আবারও শুরু হলো ফুঁপিয়ে উঠে কান্না।
কাঁপা গলায় বলল আনোয়ার, ‘কে কাঁদে? কে?’
‘আমি,’ ফোঁপাতে ফোঁপাতে জবাব দিল কোনও নারী কণ্ঠ।
‘আমি কে?’
‘আমি খেয়া।’
‘খেয়া?’ চিনতে পারল আনোয়ার। দোতলার ভাড়াটিয়া সোবহান সাহেবের ছোট মেয়ে।
‘হ্যাঁ।’
‘তুমি এখানে কীভাবে এলে?’
‘আমি জানি না।’
‘তাড়াতাড়ি বাসায় যাও।’
‘আমি উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পাচ্ছি না।’
‘খেয়া, কেউ দেখে ফেললে কী ভাববে, বলো তো!’
আবার কাঁদতে লাগল খেয়া।
‘আস্তে, খেয়া, আস্তে,’ বলল আনোয়ার। ‘শব্দ কোরো না।’
খেয়ার কান্নার শব্দ একটু কমে এল, তবে পুরোপুরি মিলিয়ে গেল না। উঠে বসে বাতি জ্বালল আনোয়ার। কই, কেউ তো নেই! চিলেকোঠার দরজা খুলে এল ছাদে। নাহ্, ছাদেও কেউ নেই। ছাদের দরজাও তালাবদ্ধ। এখনও কাঁপছে ওর বুকটা। এসব কী দেখছে ও? ক্লান্ত ভঙ্গিতে নিজের রুমে ঢুকল আনোয়ার। এরপর যে দৃশ্যটি দেখল, তাতে কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে গেল ওর হৃৎস্পন্দন। ওর ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলছে খেয়া। আত্মহত্যা করেছে। বেরিয়ে আছে জিভ। চোখ খোলা, বীভৎস এক দৃশ্য। বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারল না আনোয়ার, পড়ে গেল মাথা ঘুরে। ঠিক তখনই জোরে হেসে উঠল কে যেন! হাসিটা চিনতে পারল আনোয়ার। হাসছে রাইয়ান্! রাইয়ান ওর সাথে মজা করছে বুঝতে পারল আনোয়ার। এটা এক ধরনের খেলা।
পিশাচের হাসি হেসে বলল রাইয়ান, ‘আমাকে তুই চিনতে পেরেছিস? আমাকে জন্মের সাথে-সাথে এতিমখানায় ফেলে এসেছিলি তুই। আমার বাবার সাথে অনেক হিসেব-নিকেশ আছে তোর। আর আমার প্রিয় নানাজান মেরে ফেলতে বলেছিল আমাকে।’ কথাগুলো শুনতে-শুনতে চোখ বন্ধ হয়ে এল আনোয়ারের।
তেইশ
পরদিন সকালে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করল আনোয়ার। মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে দেখল, নুযহাতের বাবা রফিক সাদি ফোন দিয়েছেন ওকে। তিনি কানাডা চলে যাওয়ার পরেও প্রায় প্রতি মাসেই ফোন করতেন। তবে গত কয়েক মাস ধরে কোনও যোগাযোগ নেই।
আনোয়ারকে উৎফুল্ল গলায় রফিক সাদি বললেন, ‘আমরা গত পরশুদিন এসেছি দেশে। আমার সাথে নুযহাতও এসেছে।’