হাতজোড় করে বললেন মুবিন চৌধুরী, ‘আপনার কাছে অনুরোধ, আমাদের কাছে আনবেন না রাইয়ানকে।’
মন দিয়ে সব শুনেছে আনোয়ার। রুমের পেইন্টিংগুলো দেখতে দেখতে বলল, ‘রাইয়ান সম্পর্কে অজানা বিষয় জানতেই এসেছিলাম। আগেই বলেছি, এসব বিষয়ে আমার আছে প্রবল আগ্রহ। আপনাদের এসব তথ্য অনেক কাজে লাগবে আমার। আপনারা কি বলবেন কোন্ এতিমখানা থেকে এনেছিলেন রাইয়ানকে?’
নাম মনে করার চেষ্টা করলেন মুবিন চৌধুরী। কয়েক সেকেণ্ড পর বললেন, ‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে। শ্যামলীর ভেতর দিকে এক এতিমখানা আছে, উত্তরখান এতিমখানা। সেখান থেকে এনেছিলাম।’
বিড়বিড় করে বলল আনোয়ার, ‘আমিও ছয় বছর আগে বাচ্চাটাকে রেখে এসেছিলাম ওই এতিমখানায়।’
‘কী বললেন?’
‘না, কিছুই না।’ আবার বলল আনোয়ার, ‘আপনি কি রাইয়ানের ধ্যানের বিষয়টি আরেকটু বিস্তারিতভাবে বলবেন?’
‘হ্যাঁ। ওকে প্রায়ই দেখতাম ধ্যানের ভঙ্গিতে বসে থাকতে। মাঝে-মাঝে বিচিত্র ভাষায় কী সব বলত।’
‘ধ্যানের বিষয়টা কত বছর বয়সে প্রথম লক্ষ করেছিলেন?’
একটু ভেবে মুবিন চৌধুরী বললেন, ‘সম্ভবত চার বছর বয়সেই প্রথম এই ধ্যানের বিষয়টি লক্ষ করি।’
‘আরেকটা প্রশ্ন, একটা সত্যি জবাব চাই।’
‘হ্যাঁ, বলুন।’
‘আপনারা কি কখনও রাইয়ানের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছিলেন বা মারধর করেছিলেন?’
‘সন্তানকে মা-বাবা যে ছোটখাট শাসন করে, সেসব করতাম। আর…’
‘আর কী?’
‘রাইয়ানের চতুর্থ জন্মদিনের সময় ঘটেছিল একটা ঘটনা। হাই ব্লাডপ্রেশারের রোগী আমার স্ত্রী, সেসময়ে শারীরিক অবস্থা ভাল ছিল না তার। তাই, সেবার আমরা রাইয়ানের জন্মদিনে কোনও অনুষ্ঠান করব না বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু রাইয়ান মানতে চাইছিল না বিষয়টা। একদম প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মত আমাদেরকে চার্জ করতে লাগল। আমার ছেলে-মেয়েদের সাথে ওর সম্পর্ক একদম মধুর ছিল না। তখন সবাই মিলে অনেক কটু কথা বলে ফেলেছিলাম ওকে।’
‘সম্ভবত ওই সময়েই রাইয়ান জানতে পারে, দত্তক আনা হয়েছিল তাকে। ঠিক না?’
আনোয়ারের বিচক্ষণ অনুমানে অবাক না হয়ে পারলেন না মুবিন চৌধুরী। বললেন, ‘জী, ঠিক। রাগ করে সেদিন কথাটা বলে ফেলেছিল আমার মেয়ে সভ্য। ‘তুই আমাদের আপন ভাই না, এ জন্যই মায়ের কষ্টের কোনও মূল্য নেই তোর কাছে।’’ মুবিন চৌধুরী অপরাধীর গলায় বললেন, ‘তবে বিশ্বাস করুন, আমরা কখনও ওকে আলাদা করে দেখিনি। আমার অন্য দুটি ছেলে-মেয়ে হয়তো একটু অবহেলা করেছে, কিন্তু আমরা তাদের অন্যায়কে প্রশ্রয় দিইনি।’
‘আজ অনেকগুলো হিসাব মিলে গেল,’ দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বলল আনোয়ার।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি উঠি।’
মূর্তির মত বসে রইলেন মুবিন চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী, একবারও দেখলেন না আনোয়ারের দিকে।
আনোয়ার লক্ষ করল, চোখে পানি মরিয়ম বেগমের। হয়তো এই ভয়ঙ্কর সন্তানটিকে এখনও খুব ভালবাসেন তিনি।
একুশ
ডা. রাশেদের চেম্বারে ঢুকল আনোয়ার। এই মানুষটার সাথে খুব সখ্য রয়েছে তার। ডাক্তার হিসাবে রাশেদ যেমন প্রথম শ্রেণীর, মানুষ হিসাবেও। ঢাবির ছাত্র হলেও রাশেদের সাথে ঢাকা মেডিকেলে প্রচুর আড্ডা দিয়েছে আনোয়ার। ওর চেয়ে রাশেদ বয়সে একটু বড় হলেও সম্পর্কটা একদম বন্ধুর মত।
আনোয়ারকে দেখে উৎফুল্ল গলায় বলল রাশেদ, ‘কী, আনোয়ার, সরাসরি আমার চেম্বারে? কোনও বিশেষ দরকার?’
হেসে বলল আনোয়ার, ‘রাশেদ ভাই, একটা বিষয়ে কথা বলার জন্য আপনার কাছে এসেছি। আপনি যেমন আন্তরিকভাবে সবকিছু বুঝিয়ে বলবেন, অন্য জায়গায় এটা সম্ভব নয়, তাই জ্বালাতে এলাম।’
‘আরে, জ্বালানো বলছ কেন?’ চশমা খুলতে খুলতে বলল ডা. রাশেদ, ‘খুব খুশি হয়েছি। অনেকদিন দেয়া হয় না আড্ডা। তবে তোমাকে আধঘণ্টা বসতে হবে। আরও দু’জন রোগী দেখা বাকি।’
‘কোনও সমস্যা নেই, রাশেদ ভাই। আমি বাইরে বসছি।’
‘ঠিক আছে।’
চল্লিশ মিনিট পর ডাক পড়ল আনোয়ারের।
অনেকক্ষণ রোমন্থন চলল পুরনো স্মৃতির। এরপর হালকা স্ন্যাকস খেল দু’জন। ডা. রাশেদ হাত-পা ছড়িয়ে চেয়ারে বসল। এরপর বলল, ‘এবার বলো কী জানতে চাও?’
‘রাশেদ ভাই, মৃত মানুষ কি কখনও জীবিত হতে পারে? এমন কোনও বিষয় কি মেডিকেল সায়েন্সে আছে?’
গম্ভীর হয়ে গেল ডা. রাশেদ। কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘না। মৃত মানুষ কখনও জীবিত হতে পারে না।’
‘তা হলে যে প্রায়ই পত্রিকায় পড়ি মৃত্যুর এত ঘণ্টা পর বেঁচে উঠলেন রোগী, আবার সেদিন পড়লাম পোস্টমর্টেমের সময় রোগী নড়ে উঠল। এসব বিষয়ে কী বলবেন?’
‘তোমাকে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি। এর একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে। ‘কী ব্যাখ্যা?
‘এরা আসলে মারা যায়নি, মানে এদের মৃতদের কাতারে ফেলা যায় না। এ ধরনের ঘটনাকে বলে স্থগিত মৃত্যু বা আপাত মৃত্যু। অনেকে এটাকে বলে পুনর্জীবিত স্থগিত মৃত্যু। প্রথমেই আসি পত্রপত্রিকায় আমরা যেসব খবর পড়ি, সে বিষয়ে। আসলে ডাক্তাররা প্রাথমিকভাবে বিপি, পাস্ চেক করেই ধরে নেয় মারা গেছে রোগী। কিন্তু সত্যিকার অর্থে কিছু রোগী তখনও মারা যায়নি। হয়তো খুব স্তিমিত গতিতে কাজ করছে তার হার্ট। এক্ষেত্রে নিশ্চিত হওয়ার জন্য করতে হয় ইসিজি। ওটা করলেই নিশ্চিতভাবে বোঝা যাবে, রোগী মারা যায়নি; তবে এসব ক্ষেত্রে রোগীর বেঁচে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই কম।’