মামার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মেয়েটার ভাগ্য খুব খারাপ। মনে হচ্ছে ওকে বাঁচানো কঠিন হবে।’
মামা কাঁদো-কাঁদো মুখে বললেন, ‘এসব কী বলছেন?’
‘খারাপ এক জিনের কবলে পড়েছে মেয়েটা। জিনটা মুক্তি দিতে না চাইলে মেয়েটা বাঁচবে না।’
মামা হাত জোড় করে বললেন, ‘আপনি ওকে বাঁচান, হুজুর!’
‘বাঁচানোর মালিক আল্লাহ্ পাক। তবে আমি চেষ্টা করব। জিনটার সাথে কথা বলতে হবে।‘
‘বলুন, হুজুর, কথা বলুন।‘
‘হাবভাবে মনে হচ্ছে, ওর কাছে সবসময় থাকে না জিনটা। মাঝে-মাঝে আসে। তবে আমি এই মুহূর্তেই তাকে ডেকে আনার চেষ্টা করব।’
‘হুজুর, আপনি বললেন, জিনটা সবসময় রেহানার সাথে থাকে না। তা হলে সবসময় এত অসুস্থ হয়ে আছে কেন, হুজুর?’
‘এই খারাপ জিনের নানাবিধ ক্ষমতা আছে। প্রথম দিনেই ও রেহানার উপর প্রভাব বিস্তার করেছে। ওর সেই খারাপ শক্তির প্রভাবে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে মেয়েটা। আমার ধারণা জিনটা কিছু চায়। সেটা পেলে হয়তো ওকে ছেড়ে দেবে। আমি একটু কথা বলার চেষ্টা করতে চাই। মেয়েটাকে রেখে আপনারা চলে যান।‘
‘আমরা বাইরে অপেক্ষা করি।’
‘না, আপনারা বাড়িতে যান।‘
মামাসহ আরও বেশ কয়েকজন লোকমান ফকিরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
লোকমান ফকির চোখ বন্ধ করলেন। এরপর জোরে জোরে দোয়া-দরূদ পড়তে শুরু করলেন। একসময় এল জিনটা। তখন আমি পুরোপুরি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। মুখ দিয়ে বেরোতে লাগল ফেনা। জিনের সাথে লোকমান ফকিরের বেশ কিছু কথা হলো।
জিন প্রথমে এসে লোকমান ফকিরকে সালাম দিল
লোকমান ফকির সালামের উত্তর দিলেন।
লোকমান ফকির বললেন, ‘তুই কে?’
‘আমি খান্নাস।’
‘খান্নাস তুই!’
‘জী, হুজুর। আমি খান্নাস। বহু বছর ধরে আমি আপনার অধীনে আছি।’
‘মেয়েটাকে কষ্ট দিচ্ছিস কেন? তোর মতলব কী?’
‘মেয়েটাকে আমি পেতে চাই।’
‘না। এটা কখনোই সম্ভব নয়।
‘হুজুর, তা হলে মেয়েটাকে আমি মেরে ফেলব।’
‘আমি তোকে কষ্ট দেব। তুই কিন্তু আমার অধীনস্থ। তোকে আমার কথা শুনতে হবে।‘
‘হুজুর, আমি আপনার কথা শুনব। ওকে সারিয়ে তুলব। ওকে ছেড়ে দেব। তবে…’
‘তবে কী?’
‘আপনাকেও এই গোলামের কিছু কথা শুনতে হবে।’
‘বল, তুই কী চাস।’
‘হুজুর, আপনি আমাকে এই গ্রামে আটকে রেখেছেন। আপনার জন্য আমি ঠিকমত চলাচলের সামর্থ্যও হারিয়েছি। তাই আমাকে আপনার মুক্তি দিতে হবে।’
‘আচ্ছা, যা, তোকে আমি মুক্তি দেব।’
‘শুকরিয়া, হুজুর। আর একটা আর্জি শুনতে হবে, হুজুর।’
‘আবার কী?’
‘মেয়েটাকে আমার পছন্দ হয়েছে। তাই ওকে ভুলতে পারব না। ওকে ছেড়ে যাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু ও যেন সারাজীবন চিরকুমারী থাকে। মেয়েটা যদি কখনও বিয়ে করে, তা হলে আমি আবার ওর জীবনে ফিরে আসব।’
‘আচ্ছা, তাই হবে।’
খান্নাস আবারও সালাম দিয়ে বিদায় নিল।
একটু পর আমি চোখ মেলে তাকালাম। আমার জ্বর যেন এক নিমেষে কমে গেছে। মনের ভেতরের চাপা ভয়টাও আর নেই। এতদিন যে ঘোরের মধ্যে ছিলাম, সেই ঘোর থেকেও পুরোপুরি বেরিয়ে এসেছি।
আমি লোকমান ফকিরের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘হুজুর, পানি খাব।’
লোকমান ফকির আমাকে পানি এনে দিলেন। এরপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিলেন। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, আমি তো ওই সময় ঘোরের মধ্যে ছিলাম। এমনকী অনেক সময় অজ্ঞানও হয়ে যেতাম। তা হলে, লোকমান ফকিরের সাথে জিনের কথোপকথন বা অন্যান্য বিষয় এত বিস্তারিত কীভাবে বর্ণনা করলাম? উত্তরটা সহজ। আমি সুস্থ হওয়ার পর মামা আমাকে সবকিছু বলেছিলেন। প্রথম দিকে তিনিও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, কখনও আমার বিয়ে দেবেন না। কিন্তু সময়ের সাথে-সাথে মানুষের ভয় কমে যায়। অতীতকে খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যায় মানুষ।
কয়েক মাস আগে মামা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। দুই বছর আগে তিনি লায়লার বিয়ে দিয়েছিলেন। তাই আমাকেও বিয়ে দিয়ে চিন্তামুক্ত হতে চেয়েছিলেন। লোকমান ফকিরের নিষেধ মনে করিয়ে দেয়া হলো তাঁকে। কিন্তু তিনি এত আগের বিষয়টার তেমন গুরুত্ব দিতে চাইলেন না।
যথাসময়ে আমার বিয়ে হলো। আমার বর সেজান আমাদের পাশের গ্রামের ছেলে। তারও মা-বাবা কেউ নেই। আপন বলতে এক চাচা। তার চাচার সাথে মামার খুব ভাল বন্ধুত্ব ছিল। তাই বিয়ের কথা পাকা হতে সময় লাগল না।
বরকে আমার খুব পছন্দ হলো। সে যে আমাকে সুখে রাখবে, এ ব্যাপারে আমার কোনও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু বাসর রাতেই ঘটল বিপত্তি। সেজান আমার কাছে আসতেই আমার মনে ঘটতে শুরু করল অদ্ভুত কিছু। আবার সেই নগ্ন লোকটাকে দেখলাম। তার শরীরের গর্তগুলো আরও বড় হয়েছে। অসংখ্য পোকা কিলবিল করছে সেই গর্তে। কিছু-কিছু পোকার মুখে আবার ডিম রয়েছে। সেই লোকটা আগের মত আমাকে বলল, ‘রস খাবা?’
আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম। মুখ দিয়ে বেরোতে লাগল ফেনা।
এরপর থেকে প্রায়ই ওই লোকটার বেশ ধরে খান্নাস ফিরে আসে। কখনও স্বপ্নে, কখনও-বা তাকে সরাসরি দেখি। খান্নাসের ভাব-ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে, সে আমার এবং সেজানের বড় কোনও ক্ষতি করবে। ইতিমধ্যে সে কয়েকবার আমাদের বাসা লণ্ডভণ্ড করেছে। এমনকী নীচে ফেলে দিয়েছে ঘরের ফ্যান। সেজান এসবের কারণ বুঝতে পারছে না। বেচারা খুব কষ্টের মধ্যে পড়েছে। আমি তাকে সবকিছু খুলে বলব ভাবছি। তাকে বলব, আমাকে তালাক দিতে। তা হলে হয়তো সে ওই ভয়াবহ খান্নাসের হাত থেকে মুক্তি পাবে। নিজের জীবন নিয়ে অবশ্য অত ভাবি না। মৃত্যুই আমার একমাত্র মুক্তি।