আবারও বলতে শুরু করলেন মুবিন চৌধুরী: ‘চার বছর বয়সে রাইয়ান ধারাল এক ছুরি নিয়ে আমাদের বাসার বেড়ালটার মাথা কেটে ফেলেছিল। শুধু মাথা কেটেই ক্ষান্ত হয়নি, সে বিড়ালের পুরো দেহটাও খণ্ড-বিখণ্ড করেছিল। ছোট বাচ্চারা যেমন কোনও কাজ করে সবাইকে আগ্রহ নিয়ে দেখাতে থাকে, তেমনি রাইয়ানও সেদিন আগ্রহ করে সবাইকে দেখাতে থাকে বিড়ালের খণ্ড-বিখণ্ড দেহ। তার পুরো শরীর রক্তে ভেজা। এই দৃশ্য দেখার জন্য আমি এবং আমার স্ত্রী, কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। রাইয়ানের আচরণে হতবাক আমার অন্য দুই ছেলে-মেয়েও। চার বছর হওয়ার পর থেকেই প্রতিটা দিন যেন বদলে যেতে লাগল, রাইয়ান। বাসার অন্ধকার কোণগুলোতে লুকিয়ে থাকত। আর রক্ত সম্পর্কিত অস্বাভাবিকতা বাড়ছিল দিন-দিন। মাঝে-মাঝে আনমনে বিড়বিড় করে নিজের সাথে কথা বলত। এর মধ্যে আমার স্ত্রী একটা স্বপ্ন দেখল। ভয়ঙ্কর দর্শন এক প্রাণী মানুষের গলায় বলছে, ‘আমার ছেলেকে তোরা কেড়ে নিতে চেয়েছিলি, কিন্তু পারবি না।’ স্বপ্ন নিয়ে বিচলিত হওয়া ঠিক নয়, কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতিতে আমরা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। রাইয়ানের মধ্য থেকে পুরোপুরি হারিয়ে গেল স্বতঃস্ফূর্ত ভাবটা। সে হাসতে ভুলে গেল, খেলাধুলো করত না, ঠিকমত কথা বলতেও চাইত না। খাওয়া-দাওয়াও তেমন করত না। এই অবস্থায় আমরা ভাবলাম, কোনও মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব ওকে। কিন্তু রাইয়ান কীভাবে যেন টের পেয়ে গেল বিষয়টা, কোনওভাবেই রাজি হলো না ডাক্তারের কাছে যেতে। এভাবেই পার হলো খারাপ একটা বছর। এরপর রাইয়ানের বয়স যখন পাঁচ হলো, তখন…’ চুপ হয়ে গেলেন মুবিন চৌধুরী।
আনোয়ার বলল, ‘তখন কী?’
‘তখন হুট করেই মারা গেল সে।’
বিস্মিত হয়ে বলল আনোয়ার, ‘মারা গেল?!’
কপালের ঘাম মুছে মুবিন চৌধুরী বললেন, ‘হ্যাঁ, মারা গেল। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগের কথা বলছি। একদিন সকালে রাইয়ান ঘুম থেকে উঠতে দেরি করলে কেমন যেন সন্দেহ হয় আমাদের। অনেক ডেকেও কোনও সাড়াশব্দ পাচ্ছিলাম না। পরবর্তী সময়ে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকি আমরা। দেখলাম বিছানায় এলিয়ে পড়ে আছে রাইয়ানের শরীরটা। ঠাণ্ডা হয়ে আছে সারাশরীর। প্রাণের কোনও চিহ্ন নেই চেহারায়। দ্রুত গিয়ে একজন ডাক্তার নিয়ে এলাম। ডাক্তার পাল্স, বিপি, চোখ দেখে বলল, ‘আপনাদের সন্তান আর বেঁচে নেই।’
‘এমন মৃত্যু আমাদের কারও কাম্য ছিল না। ভয়ঙ্করভাবে ভেঙে পড়লাম। কষ্টে যেন ফেটে যাচ্ছিল বুকটা। কী কোমল একটা মুখ, আর কোনও দিন ডাকবে না বাবা বলে। যত অস্বাভাবিকতাই থাকুক, সে তো আমাদের সন্তান। ডাক্তার চলে যাবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দাফনের প্রস্তুতি শুরু করলাম আমরা। রাইয়ানকে গোসল করানো হলো, কাফনের কাপড় পরানো হলো। আমরা যখন কবরস্থানের দিকে রওয়ানা দেব, তখন হঠাৎ উঠে বসল রাইয়ান। পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ল ভয়ের পরিবেশ। কেউ-কেউ সহজভাবে মেনে নিতে পারছিল না ওকে। মুহূর্তেই খালি হয়ে গেল পুরো বাড়ি। আমার দুঃখের অনুভূতিও কেমন যেন রূপান্তরিত হলো ভয়ে। ডাক্তার যাকে মৃত ঘোষণা করল, সে কীভাবে বেঁচে উঠল? এ ঘটনার পর আমরা আর ভালভাবে গ্রহণ করতে পারিনি রাইয়ানকে।
‘রাইয়ান বেঁচে ওঠার পর ওর মধ্যে আসতে শুরু করল নানা পরিবর্তন 1 রেগে উঠত অল্পতেই। কারণে অকারণে আমার অন্য দুই ছেলে-মেয়েকে আঘাত করত। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেণ্ড ইয়ারে পড়ে আমার বড় ছেলেটা, আর মেয়েটা কলেজে, ফার্স্ট ইয়ারে। বয়সে বড় হওয়া সত্ত্বেও রাইয়ানের শক্তির কাছে হার মানতে হতো ওদের। প্রায়ই ঘরের অন্ধকার কোণে পদ্মাসনে বসতে দেখতাম রাইয়ানকে। মনে হতো যেন ধ্যান করছে। শত ডাকাডাকিতেও সাড়া দিত না। এভাবে পার হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
‘আমাদেরও নানাভাবে কষ্ট দিতে থাকল রাইয়ান। তার কোনও কথাতে আপত্তি করলেই ভয়ঙ্করভাবে রেগে যেত। এমন কী আঘাত করতেও ছাড়ত না। ওর শক্তির কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিলাম আমরা। আর ওর ইচ্ছার কাছে ছিলাম বন্দি। ওর সন্তুষ্টির জন্য প্রায়ই বাজার থেকে কিনে আনতে হতো জ্যান্ত মুরগি। ওগুলো সে নিজ হাতে জবাই করত। রক্ত মেখে নিত নিজের গায়ে। এসব কুৎসিত দৃশ্য আমাদের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু কী রকম এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ করেছিলাম আমাদেরও মধ্যেও। রাইয়ান না চাইলে ঘর থেকেও বের হতে পারতাম না আমরা। অদৃশ্য কিছু যেন আঘাত করত আমাদেরকে। আস্তে-আস্তে আমরা বুঝতে পারলাম, অশুভ কোনও বিষয় আছে রাইয়ানের মধ্যে। কিন্তু এই অশুভ বিষয়টা কী আমরা নিশ্চিত ছিলাম না। মনে হচ্ছিল রাইয়ানকে দূরে সরিয়ে দেয়াই মঙ্গলজনক।
‘কিছুদিন আগে দ্বিতীয়বারের মত মারা গেল রাইয়ান। ওকে পরীক্ষা করে দেখল ডাক্তার, পুরো শরীর ঠাণ্ডা, হৃৎস্পন্দন নেই, পাও পাওয়া যাচ্ছে না। এবার আগের মত দেরি করিনি। বেশি লোক জানাজানিও হয়নি। মৃত্যুর তিন ঘণ্টার মধ্যেই দাফন করা হলো রাইয়ানকে। ওকে কবরে শুইয়ে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু কবর দেয়ার পরদিন আমরা খবর পেলাম, চুরি হয়ে গেছে রাইয়ানের লাশ। আর আজকে আপনার কাছে শুনলাম, বেঁচে আছে ও।’
‘হ্যাঁ। রাইয়ান বেঁচে আছে। আমার কাছেই আছে।’