একঘণ্টা পার হয়ে গেছে, বৃষ্টিও থেমেছে বেশ আগে, কিন্তু দেখা নেই লোকমানের! এত কষ্টের পর ফল না মেলায় কেমন জেদ চেপে গিয়েছিল রইসের। এই লাশ নিয়ে এখন সে কী করবে? তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিল, লোকমানের বাসায় যাবে সে, আর রাস্তার পাশে লাশ নিয়ে বসে থাকবে সুফিয়া। এর মাধ্যমে লাশ দাফনের কথা বলে মানুষের কাছ থেকেও পাওয়া যাবে কিছু টাকা। আর এর মধ্যে লোকমানকে খুঁজে বের করবে রইস। ছোট বাচ্চাটার লাশ থেকে কাফনের কাপড় খুলে ফেলে সুফিয়া। নিজের ছেলের ছেঁড়া প্যান্টটা পরিয়ে দেয়। তারপর একসময় বনানীর ওই রাস্তায় আনোয়ারের সাথে দেখা হয়েছিল সুফিয়ার।
সাধনা – ২০
বিশ
কবরস্থানের গার্ডের কাছ থেকে রাইয়ান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারল আনোয়ার। লাশ চুরি হয়েছে তা ইতিমধ্যে রাইয়ানের পরিবারকে জানিয়েছে গার্ড, কিন্তু তারা এ বিষয়ে কোনও ভ্রুক্ষেপ করেনি।
এই মুহূর্তে রাইয়ানের বাবা মুবিন চৌধুরীর সামনে বসে আছে আনোয়ার। বেশ ক’দিন দেখা করতে চেয়েছে, কিন্তু সুযোগ মেলেনি। শেষপর্যন্ত আজ রাজি হয়েছেন মুবিন চৌধুরী, যদিও আনোয়ারের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে বেশ সংশয়ে আছেন তিনি
মুবিন চৌধুরী আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত মুখে বললেন, ‘আমার কাছে কী দরকার?’
শান্ত গলায় বলল আনোয়ার, ‘আসলে আপনার ছেলে রাইয়ান সম্পর্কে একটু আলাপ করতে এসেছি।’
মুবিন চৌধুরী বললেন, ‘রাইয়ান! রাইয়ানকে নিয়ে কী কথা?’
‘রাইয়ান কবে মারা গিয়েছিল, কীভাবে মারা গিয়েছিল, এই বিষয়টা আমি জানতে চাই।’
‘আমি এ বিষয়ে কোনও কথা বলতে চাই না।’ চোখ আরেক দিকে সরিয়ে নিয়ে বললেন মুবিন চৌধুরী। ‘আপনি আসলে কে, বলুন তো?’
‘রাইয়ানের লাশ চুরি হয়েছে, জানেন তো?’
ভয়ের ছায়া পড়ল মুবিন চৌধুরীর চেহারায়। তিনি ভীত গলায় বললেন, ‘আপনি কি গোয়েন্দা বিভাগের কেউ?’
মাথা নেড়ে বলল আনোয়ার, ‘আমি গোয়েন্দা নই।’ একটু বিরতি দিয়ে বলল, ‘আসলে রহস্যময় এবং ব্যাখ্যাতীত বিষয়গুলো সম্পর্কে এক ধরনের আগ্রহ আছে আমার। নিতান্ত কৌতূহল থেকেই এসব বিষয়ের পিছনে ঘুরে বেড়াই।’
‘এর সাথে রাইয়ানের কী সম্পর্ক?’
‘আমার মনে হচ্ছে, রাইয়ানের মধ্যে এক ধরনের রহস্য ছিল, যেটা আপনি জানেন।’
‘এমন কিছু আমার জানা নেই। আর নিজের পারিবারিক বিষয়ে আপনার সাথে কথা বলব না।’ কড়া গলায় বললেন মুবিন চৌধুরী, ‘আপনি এখন আসুন।’
অনেকভাবে বোঝাতে চেষ্টা করল আনোয়ার, কিন্তু মুবিন চৌধুরী অনড়। পারিবারিক বিষয়ে তিনি কোনও কথা বলবেন না।
শেষ চেষ্টা করল আনোয়ার। ‘আপনি কি জানেন, আপনার ছেলে রাইয়ান বেঁচে আছে?’
ভয়ানকভাবে চমকে উঠলেন মুবিন চৌধুরী। মুহূর্তেই ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করল মুখমণ্ডল। এক দৃষ্টিতে আনোয়ারের দিকে চেয়ে রইলেন। বললেন, ‘কী বললেন? রাইয়ান বেঁচে আছে?!’
‘হ্যাঁ, সবই বলব,’ জবাবে বলল আনোয়ার। ‘তবে তার আগে আমার কৌতূহল মেটাবেন আপনি। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর চাই।’
মুবিন চৌধুরীকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তাঁকে গ্রাস করেছে এক রাশ অস্বস্তি। চোখেমুখে বিষণ্ণতার ছায়াও পড়ল। নিচু গলায় ডাকলেন স্ত্রী মরিয়মকে। এমন ভাবে, যেন স্ত্রী না এলেই খুশি হতেন। সবকিছু ছাপিয়ে ক্লান্তির ছাপই ফুটে উঠেছে মরিয়ম বেগমের চেহারায়। অসম্ভব রূপবতী মহিলার চোখের নিচে কালি, চুলগুলো খানিকটা এলোমেলো। কিছু দিন আগে ছেলে হারিয়েছেন, চেহারায় এমন দুঃখ এবং ক্লান্তির ছাপ পড়াই স্বাভাবিক। মরিয়ম বেগম আনোয়ারের সামনে এসে বসলেন, ঠিক মুখোমুখি। মুবিন চৌধুরী মরিয়মের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যা সন্দেহ করেছিলাম, ঠিক তা-ই। উনি রাইয়ানের খোঁজ নিয়ে এসেছেন।’
মরিয়ম বেগমের চেহারা এক মুহূর্তে যেন বদলে গেল। ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আনোয়ারের দিকে। বললেন, ‘মৃত মানুষের কোনও খোঁজ থাকে না।
‘আপনাদের ছেলে রাইয়ান বেঁচে আছে,’ বলল আনোয়ার।
হিংস্র গলায় বললেন মরিয়ম বেগম, ‘মৃত রাইয়ান আমাদের ছেলে, জীবিত রাইয়ান নয়।’
কথাটার অর্থ ঠিক বুঝতে পারল না আনোয়ার। মুবিন চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করল সবকিছু খুলে বলতে।
বলতে শুরু করলেন মুবিন চৌধুরী, ‘আসলে রাইয়ান আমাদের নিজেদের সন্তান নয়। তিন মাস বয়সে আমরা ওকে এক এতিমখানা থেকে দত্তক এনেছিলাম। আমাদের আগের দুটি সন্তান ছিল। তবু আরও একটা সন্তানকে বুকে টেনে নেয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই রাইয়ানকে দত্তক নিই। রাইয়ানের সাথে অন্য বাচ্চাদের অনেক পার্থক্য ছিল। সে কখনও কাঁদত না। খিদে পেলেও না, ব্যথা পেলেও না। অন্ধকারে থাকতে পছন্দ করত। মাত্র এক বছর বয়সে দৌড়াতে পারত, আর দুই বছর বয়সে কথা বলতে শুরু করল। ছোট বাচ্চাদের মত আধো- আধো কথা না। কঠিন-কঠিন বাক্য বলত, আচার ও ভঙ্গিও ছিল বড়দের মত। প্রথম চার বছর কোনও সমস্যা ছাড়াই পার করেছিলাম আমরা। তবে ওর মধ্যে ছিল কিছু অস্বাভাবিকতা। ওর বয়স যখন তিন বছর, তখন বড় অস্বাভাবিক ঘটনাটি লক্ষ করলাম।’
‘কী ঘটনা?’ জিজ্ঞেস করল আনোয়ার।
‘তিন বছর বয়সে আমরা লক্ষ করলাম, রক্ত জিনিসটার প্রতি রাইয়ানের আগ্রহটা চোখে পড়ার মত। নিজের শরীরের কোথাও কেটে গেলে, সে খুঁচিয়ে- খুঁচিয়ে বড় করে ফেলত ক্ষতটাকে। তার নাকি ভাল লাগে রক্ত দেখতে। যেসব সিনেমায় ভায়োলেন্স বা রক্তারক্তি বেশি, সেগুলো আগ্রহ নিয়ে দেখত সে। আমরা ভাবতাম, ছোট মানুষ, হয়তো এসব দৃশ্য দেখে ভয় পাবে, কিন্তু ঘটত তার উল্টো। আমাদের বাড়িতে প্রায়ই মুরগি কিনে এনে জবাই করা হতো। আমি নিজ হাতেই মুরগি জবাই করতাম। রাইয়ান খুব আগ্রহ ভরে দৃশ্যটা দেখত এবং অনেক সময় নিজেই ছুরি হাতে জবাই করতে চাইত মুরগি। চেঁচিয়ে বলত, ‘আমাকে দাও! আমাকে দাও!’ এরপর রাইয়ানের বয়স যখন চার, তখন থেকেই মূলত সূত্রপাত হলো ভয়ঙ্কর সব ঘটনার।’ কথা থামিয়ে মুবিন চৌধুরী ঢক ঢক করে খেয়ে নিলেন এক গ্লাস পানি। বোঝা যাচ্ছে, বিষয়গুলো বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না তিনি।