‘নাহ্। যার তথ্য তার কাছ থেকেই নিতে হবে।’
ইলিয়াস উৎসাহের সাথে বলল, ‘ঠিক আছে, স্যর, আজকেই চলেন।’
তিনজনের বাসাই পার্কের কাছাকাছি, জানতে পারল আনোয়ার। বলল, ‘চলো, আজকেই কাজটা সেরে ফেলি। এ জন্য আপনাদের আরও দু’ শ’ টাকা দেব।’
টাকার কথা শুনে চকচক করতে থাকে তিনজনেরই চোখ। কোনও কাজ না করেই একদিনে তিন শ’ টাকা উপার্জন বিশাল ব্যাপার। এবার উৎসাহ দেখাল সবাই।
প্রথমে সবাইকে নিয়ে ইলিয়াসের বাসায় গেল আনোয়ার। বাসায়ই ছিল ইলিয়াসের বউ। এক কিশোরী মেয়েকে বেরিয়ে আসতে দেখল আনোয়ার। এ রাইয়ানের মা নয়। সেখানে বেশি সময় ব্যয় করল না ও।
এরপর কাদেরের বাড়িতে গেল আনোয়ার। কাদেরের বউকে দেখেও আশাভঙ্গ হলো। সে দুই-এক কথা জিজ্ঞেস করে সরে পড়ল। কাদেরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু উত্তেজনা অনুভব করছে আনোয়ার। এখন বাকি আছে একমাত্র রইস। তবে কি রইসই রাইয়ানের বাবা? ছেলে হারানোর কোনও শোক অবশ্য তার চোখে-মুখে নেই। কাদের ও ইলিয়াসকে টাকা বুঝিয়ে বিদায় করে দিল আনোয়ার।
রইসের বাসা বেশ খানিকটা দূরে। দশ-পনেরো মিনিট হাঁটতে হবে।
‘স্যর, আসলে আমার বাসা নাই, ফুটপাতেই সংসার, বলল রইস। ‘তাই নাকি!’
‘হ্যাঁ। আগে বাসা ছিল বনানীর বস্তিতে। কিন্তু একটা সমস্যায় পড়ে বদলাতে হলো বাসা। এত জলদি নতুন কোথাও বাসা পাই না। তাই কয়েক দিন ধরে ফুটপাতেই আছি।’
‘খুব কষ্ট হচ্ছে তা হলে।’
‘আর কষ্ট। এই কষ্টতেই জীবনডা শেষ হয়ে যাবে।’
রইস রাস্তার পাশে বেশ ভাল সংসার পেতেছে। সেখানে খেলাধুলা করছে ছোট দুটো ছেলে-মেয়ে।
রইস একটা পিঁড়ে বের করে আনোয়ারকে বসতে দিয়ে বলল, ‘ওদের মা পানি আনতে গেছে। একটু বসেন।’
আনোয়ার বসল। মিনিট পাঁচেক পর রইসের স্ত্রী সুফিয়া পানি নিয়ে এল। সে আনোয়ারকে তখনও ভালভাবে খেয়াল করেনি। হঠাৎ তার দিকে তাকাল আনোয়ার। হ্যাঁ, সেইদিনের সেই মহিলা, রাইয়ানের মা!
আনোয়ারকে চিনতে পেরে যেন আকাশ থেকে পড়ল রাইয়ানের মা। অতি দ্রুত রইসকে কানে-কানে কী যেন বলল। শুনে রইসের চোয়াল ঝুলে পড়ল। আমতা-আমতা করতে লাগল সে। দু’জনে এসে জড়িয়ে ধরল আনোয়ারের পা বলল, ‘স্যর, আমাদের মাফ করে দেন!’
‘তোমাদের তো পুলিসে দেব ঠিক করেছি।’
‘না-না, স্যর। এই কথা কইবেন না। আপনার ভয়ে বাসা বদলাইছি। মেরাজের বাপ আপনারে চিনলে বাড়িতে আনত না,’ বলল মহিলা।
‘ঠিক আছে, পুলিসে দেব না। তবে একটা শর্ত আছে।
‘কী শর্ত?’
‘আমাকে সব কথা সত্যি বলতে হবে। কিছুই গোপন করবে না।’
দু’জনের ভয় ও কান্না একটু কমল।
আবারও আনোয়ার বলল, ‘কী? বলবে তো? নইলে…’
‘না-না, স্যর, বলব। কিন্তু আমাদের পুলিসে দিয়েন না। জীবনে একটা অন্যায় করেই ধরা খাইছি,’ কাতর গলায় বলল রইস।
আনোয়ারের সরাসরি প্রশ্ন: ‘রাইয়ান কি তোমাদের ছেলে?’
‘রাইয়ান কে?’ পাল্টা প্রশ্ন করল রইস।
‘তোমরা যে ছেলেকে মৃত সাজিয়ে ভিক্ষা করছিলে, তার কথা বলছি।’
‘ওই পোলার নাম তো আমি জানি না। আর…’
‘আর?’
‘ওই পোলাকে আমরা লাশ সাজাইনি। ও মারা গেসিল।’
‘মানে?!’ উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ল আনোয়ার।
‘স্যর, আপনারে সব বলতাছি। কিন্তু আপনি আমাদের পুলিসে দিয়েন না।’
‘আচ্ছা, কথা দিলাম, পুলিসে দেব না। তোমাদের কোনও ক্ষতিও করব না।’
উনিশ
রইস পুরো ঘটনাটা বলল আনোয়ারকে। তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য হচ্ছে: রইস রমনা পার্কে কাজ করার সময় এক ধুরন্ধর লোকের সাথে তার পরিচয় হয়। নাম তার লোকমান। সে রইসকে বুদ্ধি দেয় কবর থেকে লাশ চুরি করার। প্রথমে বিষয়টা রইসের একদম পছন্দ হয়নি। কিন্তু লোকমান নানাভাবে বোঝাতে থাকল। একটা টাটকা লাশ চুরি করে আনলে বিশাল লাভ। অনেক দামে লাশটা বিক্রি করা যাবে। লোভের কাছে পরাজিত হয়েছিল রইস। কিন্তু কথা তুলল, ‘লাশটা কার কাছে বিক্রি করব?’
‘আমার কাছে আনলে, আমিই কিনে নেব,’ বলল লোকমান।
‘কত দেবেন?’
‘পাঁচ হাজার টাকা।’
রইস চিন্তা করে দেখল পাঁচ হাজার তার জন্য অনেক টাকা। একবার লাশটা চুরি করতে পারলেই …
এরপর কবরস্থানে কড়া নজর রাখছিল রইস। প্রায় প্রতিদিনই গড়ে ছয়- সাতজনের দাফন হয় কবরস্থানে। সে উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সুযোগ ধরা দিচ্ছিল না। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। রইস দেখল কয়েকজন মানুষ এসেছে লাশ দাফন করতে। সে সুযোগ পেয়ে মিশে গেল লোকগুলোর সাথে। এক ছোট বাচ্চাকে দাফন করতে এসেছে সবাই। ভাল করে কবরটা দেখে রাখল রইস। এই কবরস্থানের আশপাশে তেমন কোন জনবসতি নেই। তার উপর আজ বৃষ্টি। কেউ এদিকে আসবে বলে মনে হয় না। সন্ধ্যার দিকে লাশটা চুরি করার মতলব তার।
পরিকল্পনা অনুযায়ী চুপিচুপি সন্ধ্যায় কবরস্থানে ঢুকল রইস এবং তার স্ত্রী। গতকাল রাতে কবরস্থানের ঝোপঝাড়ের মধ্যে কোদাল আর শাবল রেখে গিয়েছিল তারা। সারাদিনের বৃষ্টি আরও সহজ করে দিয়েছিল তাদের কাজকে। কোথাও দেখা যাচ্ছিল না কবরস্থানের পাহারাদারকে। এই লোকটা সন্ধ্যার দিকে নেশা করার জন্য বেরিয়ে পড়ে। তাই তাকে নিয়ে চিন্তা নেই। কাজে নেমে পড়ে রইস। তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল, তাই কারও আসারও সম্ভাবনা নেই। এই লাশটা তাকে চুরি করতেই হবে। তারা সঙ্গে করে এনেছে বড় একটা বস্তা। ওটার মধ্যেই লাশটাকে ভরে ফেলল। বস্তা কাঁধে চাপিয়ে ধীরে-ধীরে হাঁটতে থাকল রইস। কবরস্থানের পশ্চিম কোণে মস্ত বড় জারুল গাছ। সেই গাছের নিচে লোকমানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল তারা। লোকটা আগেই বলে রেখেছিল, সন্ধ্যা সাতটার দিকে এসে নিয়ে যাবে লাশটা।