ঘড়িতে নয়টা ছুইছুই। রাইয়ান এখনও ঘুমাচ্ছে। উঠে পড়ল আনোয়ার আজ আবারও খুঁজতে বের হবে রাইয়ানের মা-বাবাকে। বাসার সবাইকে বলেছে, রাইয়ানের দিকে নজর রাখতে। আর আজকে কোনও তালা দেয়া হয়নি ছাদে। ফ্রেশ হয়ে রাইয়ানকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল আনোয়ার। এক ডাকেই জেগে গেল রাইয়ান, যেন আনোয়ারের জন্যই অপেক্ষা করছিল।
খাওয়ার টেবিলে বলল আনোয়ার, ‘রাইয়ান?’
‘হ্যাঁ।’
‘ঠিকঠাক বলো তো, তুমি কে? তোমার মা-বাবা কোথায় থাকেন?’
‘আমি জানি না।’
‘তুমি না বললে আমি পুলিসের কাছে যাব। তারা এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।’
কোনও ভাবান্তর হলো না রাইয়ানের মধ্যে। নীরস গলায় বলল, ‘আমি না চাইলে কেউ আমাকে নিয়ে যেতে পারবে না।’
‘মানে?’
‘এই বাসায় আমি কিছুদিন থাকব। আমাকে জ্বালাতন করবে না।’
‘তুমি আসলে কে?’
‘তুমি আসলে কে?’ একই ভঙ্গিতে পাল্টা প্রশ্ন করল রাইয়ান।
‘আমি? আমি আনোয়ার।’
‘তুমি আনোয়ার, আর আমি জানোয়ার। হা-হা!’
‘আমি তোমার সব খবরাখবর বের করব।’
‘খুবই ভাল। বের করো। আমিও সব জানতে চাই।’
খাওয়ার টেবিল থেকে উঠে পড়ল আনোয়ার। ঠিক করেছে, খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে রাইয়ানের বাবাকে রমনা পার্কে। সত্যিই যদি এই ছেলের নাম রাইয়ান হয়, তার বাবার নামও ‘র’ অক্ষর দিয়ে শুরু হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যেমন রায়হান, রমজান, রহমত, রহমান। একটা পরিকল্পনা করেছে আনোয়ার। বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন সময়ে প্রচুর সার্ভের কাজ করেছে ও। এখন সেই সার্ভের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাইছে। একটা যেন-তেন প্রশ্নাবলী তৈরি করে অনানুষ্ঠানিক সেক্টরের ওপর করা যেতে পারে ভুয়া সার্ভে। অনানুষ্ঠানিক সেক্টরের উত্তরদাতা হিসাবে নিতে হবে রমনা পার্কের চা-সিগারেট বিক্রেতাদেরকে। হয়তো এর মাধ্যমেই রাইয়ানের বাবাকে খুঁজে বের করা যাবে। প্রশ্নাবলীতে মূল বিষয় যেটি থাকবে, তা হলো নাম, ঠিকানা, ছেলে কয়জন, তাদের নাম, মোবাইল নাম্বার, আয়-ব্যয় ইত্যাদি। খুব সহজ সাধারণ তথ্য। প্রতিটি মানুষকে কিছু টাকাও দিতে হবে। কারণ এমনিতে সময় নষ্ট করে সঠিক তথ্য দিতে চাইবে না কেউ।
রমনা পার্কে গিয়ে প্রথমেই এক চা বিক্রেতার সাথে খাতির করে ফেলল আনোয়ার। তার কাছ থেকে দুই কাপ চা তো নিলই, এ ছাড়া বকশিস হিসাবে দিল পঞ্চাশ টাকা। চা বিক্রেতার নাম ইলিয়াস। সে এত টাকা বকশিস পেয়ে খুশিতে হয়ে গেল আত্মহারা। আনোয়ার বলল, ‘ইলিয়াস, রমনা পার্কে কতজন চা-সিগারেট বিক্রি করে?’
‘তা, স্যর, সাত-আটজন তো হবেই।’
‘সবার নাম জানো?’
‘হ্যাঁ, জানি।’
এদের সবাইকে কখন পেতে পারি?’
‘কেন, স্যার? কী দরকার?’
‘আমি একটা সার্ভে মানে জরিপ করব। এই সবার নাম, ঠিকানা, আয়-ব্যয় নিয়ে একটু তথ্য নেব আর কী। তুমি কি সবাইকে এক জায়গায় হাজির করতে পারবে?’
‘এইডা তো, স্যর, একটু কঠিন। তবে আশা করি, আপনি বারোটার দিকে সবাইকেই পাবেন। এই সময়ে কাস্টমার থাকে না, সবাই বসে-বসে ঝিমায়।’
‘আমি সবাইকে এক শ’ টাকা করে দেব। তুমি আজ বারোটায় সবাইকে এক জায়গায় হাজির করতে পারবে?’
‘হ্যাঁ, পারুম।’
‘ঠিক আছে, এখন বাজে সাড়ে দশটা। আমি পার্কে এই বেঞ্চেই বসে থাকব। তুমি সবাইকে এখানে নিয়ে আসবে।’
‘ঠিক আছে, স্যর।’
‘দেখি আরেক কাপ চা দাও।’
আনোয়ারের চোখে চশমা, হাতে কাগজ-পত্র ও কলম। কেউ যেন সন্দেহ না করে। যদি রাইয়ানের বাবা একবার তার আসল উদ্দেশ্য টের পায়, তবে নিশ্চিত পালিয়ে যাবে।
আঠারো
দুপুর বারোটায় অবাক না হয়ে পারল না আনোয়ার, আসলেই এলেম আছে ইলিয়াসের। সে সঠিক সময়েই আনোয়ারের সামনে হাজির করল সবাইকে। কেউ-কেউ অবশ্য প্রচণ্ড বিরক্ত, সার্ভের বিষয়টি তারা ভালভাবে বোঝেনি। কিন্তু কিছু কথা বললেই এক শ’ টাকা পাবে ভেবে এসেছে।
সবার দিকে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল আনোয়ার, ‘সবাই এসেছে? কেউ কি বাকি আছে?’
ইলিয়াস বলল, ‘না, স্যর। কেউ বাকি নাই।’
সবাইকে বিষয়টা সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিল আনোয়ার। সে কিছু প্রশ্ন করবে, তার ঠিকঠাক জবাব দিতে হবে। এরপর সবাই চলে যেতে পারবে পকেটে এক শ’ টাকা পুরে।
সবাই প্রশ্ন শুনে খুব আগ্রহী হয়ে উঠল। সহজ স্বাভাবিক প্রশ্ন। নাম, ঠিকানা, ছেলে-মেয়ে, এ বিষয়ে প্রশ্ন। মোট সাতজনের সাথে কথা বলতে আনোয়ারের লাগল পঞ্চাশ মিনিট। দেখল সাতজনের চারজনই কিশোর। এখনও বিয়ে করেনি। তাই চারজনকে মনে-মনে বাতিল করে দিল আনোয়ার। বাকি তিনজন বিবাহিত। তারা হচ্ছে ইলিয়াস, কাদের এবং রইস। এই তিনজনের একজন রাইয়ানের বাবা হতে পারে। কিন্তু আনোয়ার হতাশ হয়ে লক্ষ করল, এদের কারও সন্তানের নামই রাইয়ান নয়। আবার এমনও হতে পারে, মিথ্যা বলেছে রাইয়ান। তার আসল নাম হয়তো রাইয়ান নয়। ইলিয়াস, কাদের এবং রইসকে বসিয়ে বাকিদের বিদায় করে দিল আনোয়ার। টাকা পেয়ে মহা খুশি ইলিয়াস। এই ব্যাপারে খুব উৎসাহী সে।
‘আপনাদের স্ত্রীদের সাথেও অল্প একটু কথা বলতে হবে, সে জন্যও অবশ্য টাকা দেব,’ বলল আনোয়ার।
রইস বিরক্ত হয়ে বলল, ‘মেয়েছেলের সাথে আবার কথা কী?’
‘তেমন কিছু না। তাদের কাজ, আয়-ব্যয় সম্পর্কে একটু তথ্য নেব।’
‘আমাদের কাছ থেকেই নেন।’