‘আমি যাব না।’
‘মানে? তুমি তোমার মা-বাবার কাছে যেতে চাও না?’
‘না।’
‘কেন?’
কিছু না বলে কঠোর চোখে দেখল রাইয়ান। এত ছোট বাচ্চা এভাবে তাকাতে পারে, চিন্তাতেও ছিল না আনোয়ারের। কেন জানি চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হলো। রাইয়ান তার বাসায় থাকায় বিশেষ কোনও ক্ষতি হচ্ছে না। তবে তার মা-বাবাকে খুঁজে বের করতে হবে।
কেন ছেলেটা তার মা-বাবার কাছে যেতে চায় না?
তারা কি কোনও অত্যাচার করে?
কী জানি!
আগে খুঁজে বের করতে হবে রাইয়ানকে ফেলে পালিয়ে যাওয়া ওই মহিলাকে। কিন্তু দুই কোটি মানুষের মস্ত ঢাকা শহরে কোথায় খুঁজে পাবে তাকে?
অবশ্য চেহারা ভালভাবেই মনে আছে। ক্যাপটা মাথায় চাপিয়ে বেরিয়ে পড়ল আনোয়ার। বাড়ির বাবুর্চিকে বলে দিয়েছে, ঠিকমত দেখে রাখতে বাচ্চাটিকে।
রাইয়ানকে ফেলে যাওয়া ওই মহিলা বা মা-র সাথে নিজের কথোপকথন মনে করল আনোয়ার। মহিলা বলেছিল, তারা থাকে কাছের কোনও বস্তিতে। গত রাতে রাইয়ানকে পেয়েছে বনানীর সরু এক রাস্তায়। সেক্ষেত্রে খোঁজ নেয়া যেতে পারে বনানী বস্তিতে। কিন্তু তার আগে বনানীর সেই রাস্তায় আরও একবার যাওয়া দরকার। হয়তো ওই মহিলা সম্পর্কে জরুরি কোনও তথ্য দিতে পারবে ওখানকার মানুষ।
অনেক খোঁজ-খবর নেয়ার চেষ্টা করল আনোয়ার, কিন্তু নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারল না কেউ। অগত্যা সে ঠিক করল, ঢুঁ দেবে বনানী বস্তিতে। ওখানে খোঁজ নেয়ার কাজটাও সহজ হলো না। পদে-পদে বিভিন্ন আপত্তিকর কথা শুনতে হলো আনোয়ারকে। সবাই স্পষ্টভাবে বলল, রাইয়ানের মা নামে কেউ এখানে থাকে না। কেউ কেউ উচ্চারণই করতে পারল না রাইয়ানের নাম, বলল রায়হান। রাইয়ানের মা-র চেহারার বর্ণনাও দিল আনোয়ার, কিন্তু কাজ হলো না তাতেও। অনেকেই সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল তার দিকে! একজন তো বলেই বসল, ‘মেয়েছেলে দিয়া আপনার কাম কী?’
এসব কথায় দমল না আনোয়ার। খুঁজে বের করতেই হবে রাইয়ানের মা- বাবাকে।
ঢাকার আরও কয়েকটি বস্তিতে খোঁজ নিল আনোয়ার, কিন্তু ফলাফল শূন্য। ক্লান্ত হয়ে রাতে বাসায় ফিরল ও।
আনোয়ারকে দেখে দৌড়ে এল বাড়ির কেয়ারটেকার, বাবুর্চি ও কাজের মেয়ে।
‘কী হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করল আনোয়ার।
মাথা নিচু করে বলল বাবুর্চি, ‘আপনি যে বাচ্চাটাকে রেখে গিয়েছিলেন, তাকে খুঁজে পাচ্ছি না!
‘কতক্ষণ ধরে খুঁজে পাচ্ছ না?’ উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল আনোয়ার। ‘ঘণ্টা দেড়েক হয়েছে।’
‘বাসার সব জায়গায় দেখেছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘মেইনগেট বন্ধ ছিল?’
‘হ্যাঁ, ছিল।’
‘ছাদে যায়নি তো?’
‘ছাদ তো আপনি তালা দিয়ে গেছেন। যাওয়ার উপায় নেই।’
রাগে মুখে থুতু জমল আনোয়ারের। ইচ্ছা হলো সবগুলোর মুখে চড় বসিয়ে দিতে। অনেক কষ্টে দমন করতে হলো ইচ্ছেটাকে। উধাও হয়ে যেতে পারে না একটা বাচ্চা। আনোয়ার ভাবল, আগামীকাল সকাল পর্যন্ত আশপাশে খুঁজে দেখবে, তারপর জানাবে পুলিসে। এতে বাড়তি কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে, কিন্তু উপায় নেই।
বাইরে রাইয়ানকে খুঁজতে যাওয়ার আগে ছাদ ঘুরে দেখতে চাইল আনোয়ার। অবাক হয়ে লক্ষ করল, ছাদের দরজা খোলা, ওদিকে অন্ধকার। কেন জানি, মনে হলো অন্ধকারটা অন্য রাতের চেয়ে একটু বেশি গাঢ়! আস্তে-আস্তে এগিয়ে গেল আনোয়ার। কাঁপা গলায় বলল, ‘রাইয়ান।’
জবাব দিল না কেউ।
আবার বলল আনোয়ার, ‘রাইয়ান।’
অস্ফুট স্বরে কেউ বলল, ‘উঁ?’
‘রাইয়ান, তুমি কোথায়?’
‘তোমার ঘরে।’
আনোয়ার দেখল ছাদের চিলেকোঠার ঘরের দরজা খোলা, তালা নেই। অন্ধকার দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল ও, ‘তুমি এখানে কী করছ? ঢুকলে কীভাবে?’
জোরে হাসল রাইয়ান।
শরীরটা কেমন যেন শিরশির করে উঠল আনোয়ারের। রুমের বাতি জ্বালতে গিয়ে দেখল, নষ্ট হয়ে গেছে বাতি।
‘রাইয়ান, তুমি কোথায়? আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না।’
‘চোখ থাকতেও দেখতে পাচ্ছ না?’
‘না। খুব অন্ধকার।’
‘হা-হা-হা!’ হাসিটা যেন ছড়িয়ে পড়ল বহুদূরে।
‘হাসছ কেন?’
‘অন্ধকার ভয় লাগে তোমার?’
‘তুমি এসব কী বলছ?’
‘এবার বাতি জ্বালো। বাতি জ্বলবে।’
আবার সুইচ টিপল আনোয়ার। সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠল ঘরের বাতি। কিন্তু ঘরে নেই রাইয়ান!
তা হলে এতক্ষণ কার সাথে কথা বলল? দৌড়ে বেরিয়ে এসে আনোয়ার দেখল, ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে রাইয়ান।
‘রাইয়ান,’ নরম সুরে ডাকল আনোয়ার।
পেছন ফিরে তাকাল রাইয়ান
‘তুমি…এ-এখানে কী করছ?’ জিজ্ঞেস করল আনোয়ার।
‘বাসায় ভাল লাগছিল না, তাই ছাদে এসেছি।’
‘কিন্তু ছাদে তো তালা দেয়া ছিল।’
‘আমি কোনও তালা দেখতে পাইনি।’
রাইয়ানের কথা শুনে সচকিত হলো আনোয়ার। বয়স্ক মানুষের মত কথা বলছে বাচ্চাটি। যেন কোনও শিশুর মধ্যে ঢুকে গেছে কোনও বয়স্ক মানুষ!
নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বলল আনোয়ার, ‘চলো, নিচে যাই।’
আপত্তি করল না রাইয়ান, হাঁটতে লাগল ধীর পায়ে।
আবারও বলল আনোয়ার, ‘তুমি নিচে যাও, আমি আসছি।’
নিচে চলে গেল রাইয়ান। নিজের রুমটা ভালভাবে দেখল আনোয়ার। নাহ্, কোনও অস্বাভাবিক কিছু নেই। এবার টর্চ হাতে ঘুরে দেখতে লাগল ছাদটা। হঠাৎ কয়েকটা ধাতব জিনিস দেখল ও। সেগুলো তুলে নিল হাতে। নিজের অজান্তেই বলল, ‘ওহ, মাই গড!’
এ কথা বলার কারণ, ওর সামনে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়ে ছিল তালার দুটো টুকরো!
সতেরো
ধীরে-ধীরে চোখ মেলে দেখল আনোয়ার। আজ তিনতলায় ঘুমিয়েছে সে। বাসার গেস্টরুমে ছিল রাইয়ান। কাল সারারাত নানা দুঃস্বপ্ন দেখেছে আনোয়ার। সবকিছু কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। তালা খণ্ড-বিখণ্ড হওয়ার কারণও বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, কেউ যেন প্রবল আক্রোশে ভেঙেছে তালা। রাইয়ানের মধ্যে কি কোনও রহস্য লুকিয়ে আছে? নাকি একটু বেশি-বেশি চিন্তা করছে আনোয়ার?