‘আপনার সাথে যাব।’ স্পষ্ট এবং শুদ্ধ উচ্চারণ ছেলেটির।
‘আমার সাথে যাবে?!’
‘হ্যাঁ।’
‘যে মহিলাকে দেখলাম, সে কি তোমার মা?’
ছেলেটা উত্তর দিল না। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল দূরে।
‘আমার সাথে কোথায় যাবে তুমি?’ আবার জিজ্ঞেস করল আনোয়ার।
‘আপনার বাসায় যাব।’
‘এটা সম্ভব নয়। তুমি ঠিকানা বলো, বা তোমার মা-বাবার কারও মোবাইল নাম্বার থাকলে বলো। আমি তোমাকে পৌছে দেব।’
ছেলেটা কাঁদতে লাগল।
আনোয়ারের মনে হলো কোনও কোনও বাচ্চার কান্নার মধ্যেও আছে সৌন্দর্য।
বেশ কিছুক্ষণ বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর জিজ্ঞেস করল আনোয়ার, ‘তুমি তো আমাকে চেন না, আমার সাথে গিয়ে কী করবে?’
‘আমি আপনার সাথে যাব,’ যেন একটাই কথা জানে ছেলেটা।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আজ রাতে আমার সাথে থেকো। কাল তোমার মা- বাবাকে খুঁজে বের করব।’
ছেলেটা চোখ মুছল।
আশপাশে তাকিয়ে কুকুরগুলোকে আর দেখতে পেল না আনোয়ার।
সাধনা – ১৫
পনেরো
বড় রাস্তায় এসে রিকশা নিল আনোয়ার। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার বাবা কী করেন?’
কিছুই বলল না ছেলেটা। তাকে আইসক্রিম কিনে দিয়েছে আনোয়ার, মহা আনন্দে আইসক্রিম খাচ্ছে সে।
‘তোমার বাসা কোন্ এলাকায়?’ আবার প্রশ্ন করল আনোয়ার।
এবারও জবাব দিল না ছেলেটা। চোখে কোনও দুশ্চিন্তা বা উত্তেজনার ছাপ নেই।
বাসায় পৌছে গেল আনোয়ার। পথিমধ্যে নতুন জামা ও প্যান্ট কিনে দিয়েছে ছেলেটাকে। এখন তাকে কোনওভাবেই পথশিশু বলে মনে হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে কোনও ধনী পরিবারের সন্তান।
‘তোমার নামটা বলবে?’ বলল আনোয়ার।
ছেলেটা স্পষ্ট গলায় বলল, ‘আমার নাম রাইয়ান।’
‘রাইয়ান শব্দের মানে জানো?’
‘বেহেশতের একটা দরজার নাম রাইয়ান।’
‘ও।’ বিস্মিত হয়েছে আনোয়ার। বস্তির ছেলের নাম এত আধুনিক হবে? কথাবার্তাও শুদ্ধ, স্বাভাবিক। কোথায় যেন একটা খটকা লাগছে।
রাইয়ানকে আরও কিছু প্রশ্ন করল আনোয়ার। কিন্তু জবাব দিল না ছেলেটা। পরিবারের অন্যরা তিনতলায় থাকলেও, ছাদের চিলেকোঠার রুমে থাকতে পছন্দ করে আনোয়ার। রাইয়ানকে বলা সত্ত্বেও সে তিনতলায় ঘুমাতে রাজি হলো না। সে চায় আনোয়ারের সাথে ঘুমাতে।
বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়ার কিছুক্ষণের ভেতর ঘুমিয়ে পড়ল রাইয়ান। কিন্তু চোখে ঘুম নেই আনোয়ারের। মনে অনেক প্রশ্ন। কাগজ-কলম নিয়ে লেখার তেমন অভ্যাস নেই ওর, তাই মনে-মনেই সাজাতে থাকল কিছু প্রশ্ন-উত্তর।
প্রথম প্রশ্নঃ ছেলেটার বয়স ছয় বা সাতের বেশি হবে না। কিন্তু তার কথাবার্তার ভঙ্গি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মত। কেন?
উত্তর: হয়তো ছেলেটা নিয়মিত স্কুলে যায়। মা-বাবা গরিব হলেও কার্পণ্য করেনি ছেলেকে স্কুলে পাঠাতে।
কিন্তু এই উত্তর পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য মনে হলো না ওর।
দ্বিতীয় প্রশ্ন: একটা বাচ্চা ছেলে যে পথে-পথে বড় হয়েছে, সে তার বাসার ঠিকানা জানে না, এটা কীভাবে সম্ভব? যদি ধরেই নিই, সে আসলে বাসার ঠিকানা জানে না, তবে সে নিশ্চয়ই মা-বাবার নাম বলবে বা অন্তত এলাকার নাম বলবে। এসব বলছে না কেন?
উত্তর: ছেলেটা সবই জানে। কিন্তু বলতে ভয় পাচ্ছে।
তৃতীয় প্রশ্নঃ ছেলেটা ওর সাথে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল কেন? রাস্তায় আরও অনেক মানুষ ছিল। কিন্তু ছেলেটা তার সাথেই কেন যেতে চাইল? আর কেনই বা সে পালিয়ে গেল না?
উত্তর: কোনও উত্তর জানা নেই।
চতুর্থ প্রশ্ন: কুকুর বিষয়ক রহস্যটা কি? ওগুলো একটা নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত যেতে বাধ্য করেছে ওকে। তারপর সেগুলোকে আর দেখা যায়নি।
উত্তর: ওগুলো সাধারণ কুকুরই ছিল। আনোয়ারকে কোথাও নিয়ে যায়নি। পুরো বিষয়টা হয়তো মনের ভুল।
পঞ্চম প্রশ্ন: আচ্ছা, এমন কি হতে পারে, কিডন্যাপ করা হয়েছে বাচ্চাটাকে? উত্তর: না। এটা সঠিক নয়। সেরকম হলে ছেলেটা তার মা-বাবার কাছে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকত।
ষষ্ঠ প্রশ্নঃ ও যখন ছেলেটাকে ঘুমানো অবস্থায় দেখতে পায়, তখন তার শ্বাস- প্রশ্বাসের কোনও লক্ষণ ছিল না। এটা কীভাবে সম্ভব?
উত্তর: ছেলেটার দেহ সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল। তাই শ্বাস- প্রশ্বাসের বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না। আবার এমনও হতে পারে, ছেলেটাকে কোনও ঘুমের ওষুধ বা অন্য কিছু খাওয়ানো হয়েছিল। অনেক ওষুধ আছে, যার প্রভাবে ধীর হয়ে যায় মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি 1
সপ্তম প্রশ্ন: মহিলাটা বাচ্চা ফেলে পালাল কেন?
উত্তর: এর সহজ উত্তর হচ্ছে, সে প্রতারক। সত্যিকারের মা কখনও শত বিপদেও সন্তানকে ফেলে পালিয়ে যায় না।
প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়েই রাইয়ানের দিকে তাকাল আনোয়ার। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে বাচ্চাটা। ঘুমের ভিতরে হঠাৎ কিছু একটা বলে ফেলল।
কথাটা শুনে চমকে উঠল আনোয়ার।
রাইয়ান বিড়বিড় করে বলছে: ‘Revenge! I want revenge!’
এ কথার মানে কী?
সারারাত ঘুম হলো না আনোয়ারের, পায়চারি করতে লাগল ছাদে।
ষোলো
সকালে নাস্তা করে তিনতলায় বসে কার্টুন দেখতে লাগল রাইয়ান। এই মুহূর্তে চাকর-বাকর ছাড়া অন্য কেউ নেই আনোয়ারদের বাসায়। এই মুহূর্তে ব্যবসার কাজে সিঙ্গাপুরে আছে তার বাবা। আর অনেক আগেই মাকে হারিয়েছে সে।
রাইয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল আনোয়ার, ‘চলো, তোমার মা-বাবাকে খুঁজতে বের হব।’