কেন যেন খুব কষ্ট হচ্ছে ওর, চোখে চলে এল জল। আরেকবার বাচ্চাটাকে দেখে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটতে লাগল নিজ বাড়ির উদ্দেশে।
চোদ্দ
ছয় বছর পর…
রাতটা একটু অন্যরকম। অনেক আলোতেও সবকিছু কেমন আবছা, দূরের পৃথিবীকে মনে হচ্ছে অপার্থিব জগতের দৃশ্য। চোখটা কেন জানি বিশ্রাম চাইছে, কিছু দেখতেও যেন কষ্ট।
রাস্তায় জ্বলছে টিমটিমে আলো। কিছু সময় পর পর তীব্র গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দুই-একটা গাড়ি। বেশ কিছুক্ষণ ধরে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। আজ তার বাসায় যাওয়ার তাড়া নেই। ভাল লাগছে একা-একা হাঁটতে। আবার কেন জানি হচ্ছে অজানা এক আশংকা। পথ আগলে দাঁড়িয়েছে কয়েকটা কুকুর। চাপা স্বরে চিৎকার করছে তারা। হাতের নড়াচড়া এবং মুখের শব্দেও পালিয়ে গেল না। লক্ষ্যে অবিচল, সামনে এগোতে দেবে না মানুষটাকে। কিন্তু ভয় পেল না সে। দেখাই যাক কী করতে চায় কুকুরগুলো। বোঝা যাচ্ছে ইচ্ছা নেই কামড়ানোর। একটা কুকুর মুখ দিয়ে ঠেলতে লাগল তাকে। সামনে এগোতে লাগল আরও দুটো। এমন একটা ভাব, যেন কোনও নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে যেতে চাইছে। কুকুরগুলোর ইচ্ছার কাছে নিজেকে সঁপে দিল সে। বড় রাস্তা বাদ দিয়ে ছোট এক গলিতে ঢুকল কুকুরগুলো। ওদের পিছে যেতে লাগল মানুষটাও।
একটা গলি পেরিয়ে ছোট রাস্তা পাওয়া গেল। এখানে দেখা যাচ্ছে ক’জন মানুষ। রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে গল্প করছে কেউ। যানবাহনের ভিড়ও এখানে একটু বেশি। হঠাৎ আনোয়ার নামের সেই মানুষটা লক্ষ করল, রাস্তার পাশে ভিক্ষা করছে এক মহিলা। তার সামনে শুয়ে আছে একজন মানুষ। একটা সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে তাকে। সেদিকে এগিয়ে গেল কুকুরগুলো। তাই করল আনোয়ারও। ওকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল মহিলা, ‘ভাই গো! আমার বাচ্চাড়া মইরা গেছে। দাফন-কাফনের টাকা নাই। কিছু সাহায্য করেন।’
মনটাই খারাপ হয়ে গেল আনোয়ারের। প্রথমে ভেবেছিল, ঘুমিয়ে আছে কেউ, এখন বোঝা যাচ্ছে, মারা গেছে। শরীরে কোনও নড়াচড়া নেই, নিঃশ্বাস- প্রশ্বাসের কোনও চিহ্নও নেই। আনোয়ার পকেট থেকে এক শ’ টাকার একটা নোট মহিলার দিকে এগিয়ে দিল। কান্না থামিয়ে টাকাটা হাতে নিল মহিলা। কৃতজ্ঞতার ছায়া পড়ল মুখে। বলল, ‘আল্লাহ আপনার ভাল করুন।’
আনোয়ার ভাবল, একটু কথা বলা যাক মহিলার সাথে।
‘আপনি থাকেন কোথায়?’
‘এই তো, একটু সামনের বস্তিতে।’
‘আপনার স্বামী কোথায়?’
‘উনি বাসাতে।’
‘কী করেন আপনার স্বামী?’
‘রমনা পার্কে চা-সিগারেট বিক্রি করে।’
‘আপনার ছেলে মারা গেছে কখন?’
মহিলা উত্তর দেয়ার আগেই সবাইকে চমকে দিয়ে চাদর সরিয়ে উঠে বসল ছেলেটা। তেমন অবাক হয়নি আনোয়ার। বুঝতে পেরেছে পুরোটাই এই মহিলার ভণ্ডামি। নিজের ছেলেকে মৃত সাজিয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা। মহিলাকে কঠিন এক ধমক দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল আনোয়ার, তখন দেখতে পেল ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মহিলার মুখ। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে তার। দ্রুত উঠে দাঁড়াল। মহিলার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাচ্চা ছেলেটা। এখন লক্ষ করা যাচ্ছে তার বুকের ওঠা-নামা।
আনোয়ার বলল, ‘কী উঠে দাঁড়ালে কেন? নিজের বাচ্চাকে মৃত সাজিয়ে ব্যবসা? দাঁড়াও, তোমাকে পুলিশে দেব।’
বাচ্চা ছেলেটাও ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল। তার মধ্যে তেমন কোনও ভাবান্তর নেই।
আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল মহিলা, ‘এ হতে পারে না! পারে না!’ বলতে-বলতে সজোরে দৌড় দিল সে। একজন মহিলা এত জোরে দৌড়াতে পারে জানা ছিল না আনোয়ারের।
আশপাশে আরও কিছু মানুষ এগিয়ে এসেছে। তারা আনোয়ারকে বলতে লাগল, ‘এই মহিলা গত কয়েক ঘণ্টা ধরে ছেলের লাশ নিয়ে এখানে বসে আছে। অনেকেই সাহায্য করেছে। আসলে সব প্রতারণা। মা-ছেলে মিলে ভাল ব্যবসা শুরু করছে।’
উৎসুক এক লোক বলল বাচ্চাটাকে পুলিশে দিতে। ছোটবেলা থেকেই ঠক- বাটপারি শিখেছে।
আরেকজন বলল, ‘না। পুলিশে দিলে কাজ হবে না। আমরাই দু’-এক ঘা বসিয়ে দিই।’
আরও কয়েকজন তাকে সমর্থন জানাল।
সবাইকে শান্ত করতে চাইল আনোয়ার। যাকে ঘিরে এত উত্তেজনা সে একেবারে নীরব। আনোয়ার বলল, ‘এই, ছেলে, তোমার বাড়ি কোথায়?’
ছেলেটা কিছু বলল না।
আরেকজন মুখ খুলল, ‘ওই, ঠিকঠাক বল, তোর বাড়ি কোথায়?’
ছেলেটা অস্ফুট স্বরে বলল, ‘জানি না।’
নানা প্রশ্নবাণে তাকে জর্জরিত করা হলেও একই উত্তর দিল সে: জানি না।
রাত হয়েছে। আরও কিছুক্ষণ পর ভিড় হালকা হবে, ভেবেছিল আনোয়ার। কিন্তু উৎসাহ হারিয়ে বিদায় নিল না বেশিরভাগ মানুষ। নানান মন্তব্য করছে।
আনোয়ার ভেবেছিল, বাড়ি ফিরবে। তারপর মনে হলো, কে জানে, বাচ্চাটা হয়তো তার বাসা চেনে না। একে দেখে পথশিশু বলেও মনে হচ্ছে না। যেন কোনও সচ্ছল পরিবারের সন্তান। যদিও কাদামাটি মেখে আছে শরীরে, পরনে ছেঁড়া প্যান্ট ছাড়া কিছুই নেই, তবুও চেহারার মধ্যে কেমন এক আভিজাত্যের ভাব।
‘আপনারা ভিড় করবেন না, আমি ওকে থানায় নিচ্ছি, ভিড় করা লোকগুলোকে বলল আনোয়ার। ওর দাপটের ভঙ্গি দেখে সবাই ধরে নিল, ও নিজেই আসলে পুলিশের বড় অফিসার।
কয়েকজন চামচার মত সায় দিল ওর কথায়।
কেউ আপত্তি করছে না দেখে ছেলেটার হাত ধরে হাঁটতে শুরু করে ওই জায়গা থেকে সরে এল আনোয়ার। অনেকটা দূরে এসে বলল, ‘তুমি এখন কী করবে?’