আনোয়ার জানে, নির্বোধ এই প্রাণীটাকে আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এখন উপাসনা করলেও আসবে না ওই ভয়ঙ্কর পিশাচ।
পুলিশ ফোর্স নিয়ে চলে এসেছে শাহেদ চৌধুরী।
আনোয়ার জয়কে স্পর্শ করতেই লুটিয়ে পড়ল তার দেহ।
চলে গেছে পিশাচটা, কিন্তু যাওয়ার আগে নিয়ে গেছে জয়ের প্রাণটা। হঠাৎ এলেমদারি বনে শোনা গেল পোকামাকড়ের স্বাভাবিক শব্দ। বনের ঘোলাটে অন্ধকারটা কেটে গেছে।
শাহেদ চৌধুরীর দলের পুলিশ-সদস্যরা গ্রেফতার করেছে সোলেমান গাজির বেশিরভাগ সঙ্গীদেরকে। কিন্তু পালিয়ে গেছেন সোলেমান গাজির স্ত্রী।
কিছুক্ষণ পর নুযহাত ও ফারহানাকে নিয়ে ঢাকার পথে রওয়ানা দিলেন রফিক সাদি।
তেরো
দুই মাস পর…
রফিক সাদির ফোন পেয়ে হাসপাতালে ছুটে গেল আনোয়ার। প্রসব বেদনা উঠেছে নুযহাতের। ঝমঝম কুঠি থেকে ফিরেই বাচ্চাটা নষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন রফিক সাদি। কিন্তু ডাক্তার বলেছেন, এখন বাচ্চা নষ্ট করতে চাইলে মায়ের ক্ষতি হবে, মারাও যেতে পারে রোগিণী। আনোয়ারের হাত ধরে বললেন রফিক সাদি, ‘এখন কী হবে? এই সন্তান জন্ম নিলে বহু মানুষের ক্ষতি করবে। ও তো পিশাচের সন্তান।’
মুখে হাত বুলাতে-বুলাতে বলল আনোয়ার, ‘শুধু পিশাচের সন্তান নয়, নুযহাতেরও সন্তান।’
‘মানে?’
‘এই বাচ্চাটার মধ্যে মানুষ সত্তা বা পিশাচ সত্তা দুটোই থাকবে।’
‘কী বলতে চাও তুমি?’
‘যদি বাচ্চাটাকে খুব ভাল পরিবেশ দেয়া যায়, হয়তো কখনও তার পিশাচ সত্তা বেরোবে না। কিন্তু ….
‘কিন্তু কী?’
‘তার যে অভাবনীয় ক্ষমতা রয়েছে, তা চিরকাল গোপনও রাখা যাবে না। একসময় সে জানবে সবই। যেমন ধরুন, যখন সে রাগ করবে, তখন হয়তো দূর থেকেই কাউকে শাস্তি দিতে পারবে, কাউকে দূর থেকে সম্মোহিত করতে পারবে। এসব আবিষ্কার করার পরে নিয়মিত এগুলোর চর্চা করবে। আর চর্চার ফলে তার ক্ষমতাও বাড়তে থাকবে।’
‘আমি এত ঝামেলা চাই না। জন্মের পরেই একে মেরে ফেলতে হবে।’
‘কিন্তু একটু চেষ্টা করলে হয় না? প্রবল চেষ্টা করলে হয়তো কোনও দিনও তার পিশাচ সত্তাটা জেগে উঠবে না।’
‘আমি কোনও চেষ্টা করতে চাই না। ধরে নিলাম বাচ্চাটা মানুষের মতই বেড়ে উঠল। কিন্তু কী পরিচয়ে তাকে আমি মানুষ করব?’
আনোয়ার চুপ করে রইল।
রফিক সাদি নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমি আমার মেয়েকে নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাব। ঝমঝম কুঠি থেকে ফেরত আসার পরেই নুযহাত মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে, তাই তাকে সুস্থ করতে হবে। এই আবর্জনাকে কোনও অবস্থাতেই গ্রহণ করব না।’
‘তা হলে কী করতে চান?’
‘আমার অনুরোধ, তুমি একে মেরে ফেলবে।’
‘আমি? মেরে ফেলব! কী বলছেন এসব!’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল আনোয়ার।
‘হ্যাঁ, বাবা, প্লিজ, এতে না বোলো না। তুমি আমার মেয়ের জন্য এত কিছু করেছ, এই শেষ উপকারটুকু করো। হাতজোড় করে তোমার কাছে অনুরোধ করছি,’ ধরা গলায় বললেন রফিক সাদি।
দুর্বলভাবে মাথা নাড়ল আনোয়ার।
যথাসময়ে স্বাভাবিক ডেলিভারির মাধ্যমে নুযহাতের ফুটফুটে ছেলে হলো। দেখতে কী সুন্দর, চোখ ফেরানো যায় না। টানা-টানা চোখ, গোলাপি ঠোঁট আর ধবধবে সাদা গায়ের রং।
রফিক সাদি এক মুহূর্ত দেরি না করে বাচ্চাটাকে আনোয়ারের কোলে তুলে দিলেন। বললেন, ‘কাল সকালেই নুযহাতকে এখান থেকে নিয়ে যাব। ভিসা- পাসপোর্ট রেডি। দশ দিন পর কানাডা চলে যাচ্ছি আমরা। ওখানে আমার বড় ভাই থাকেন। নুযহাতকে আর দেশে ফিরতে দেব না, কিন্তু হয়তো একসময় ফিরব আমি। তুমি এই আবর্জনাটাকে আজ রাতেই শেষ করে দাও। এটা নুযহাতের নয়, পিশাচের সন্তান।’
আনোয়ারের পকেটে দশ লাখ টাকার চেক গুঁজে দিলেন রফিক সাদি, তারপর বললেন, ‘প্লিজ, রাখো এটা, কোনও প্রতিদান হিসেবে নেবে না। তুমি যা করেছ, তার প্রতিদান শুধু জীবন দিয়েই দেয়া যায়। এই টাকা এক কৃতজ্ঞ বাবার উপহার। নুযহাত যেমন আমার সন্তান, তেমনি তুমিও আমার সন্তান।
আর মানা করল না আনোয়ার।
বাচ্চাটাকে ভালভাবে তোয়ালে দিয়ে জড়িয়ে চুপিচুপি ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে এল আনোয়ার। ওখানে সিসিটিভি ক্যামেরা নেই, তাই ভয়েরও কারণ নেই। বাচ্চাটার জন্ম হয়েছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা, এখনই চারদিকে তাকাচ্ছে। আনোয়ারের শরীরের সঙ্গে লেগে আছে সে। মনে হচ্ছে আনোয়ারই তার সবচেয়ে আপন। এত ছোট বাচ্চা এর আগে কোলে নেয়নি ও। বাচ্চাদের শরীরে এত সুন্দর ঘ্রাণ থাকে, তা ও আগে জানত না। আনোয়ার ভাবছে, বাচ্চাটাকে নিয়ে কী করবে। কোনও নদী বা খালে ফেলে দেবে? নাকি রাস্তায় ফেলে রাখবে?
কিন্তু মনের অন্য এক অংশ আনোয়ারকে কঠোর সুরে বলল, এটা মানুষের বাচ্চা, মানুষ হয়ে মানুষকে হত্যা করলে নরকেও স্থান হবে না হত্যাকারীর। সত্যি যদি এই বাচ্চা একসময় ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, তখন দেখা যাবে। কোনও ধারণার ওপর ভিত্তি করে কোনও বাচ্চাকে কখনোই হত্যা করা যায় না।
বাচ্চাটাকে হত্যা করতে পারল না আনোয়ার, রাতে রাখল এক এতিমখানার বারান্দায়। কে জানে, হয়তো ওখানেই মারা যাবে বাচ্চাটা, কিংবা হয়তো তাকে কোলে তুলে নেবে কেউ।
মনে-মনে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করল আনোয়ার: ‘হে, পরম করুণাময়, এই বাচ্চা যেন চিরকাল মানুষ হিসাবেই বেড়ে ওঠে। তুমি তাকে করুণা করো। তার খারাপ সত্তাটা যেন কখনও জেগে না ওঠে।’