পকেট থেকে রিভলভারটা বের করল আনোয়ার, ধমকে উঠল, ‘খবরদার! কেউ কাছে আসবে না! একদম শেষ করে দেব!’
একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে সবাই, কিন্তু এগোবার সাহস নেই কারও।
হঠাৎ চোখ মেলে তাকাল নুযহাত, উঠে দাঁড়িয়েছে ফারহানাও। পিপাসায় ছটফট করছে জয়। রফিক সাদির দিকে ইঙ্গিত করল আনোয়ার, পরক্ষণে আকাশে গুলি করল।
নুযহাত ও ফারহানার পিছনে এসে থেমেছেন রফিক সাদি। মাথাটা কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা বলে তাঁকে আলাদা করতে পারেনি কেউ। ছুরি দিয়ে কেটে দিলেন নুযহাতের হাতের তাবিজ। খুব কাছে গিয়ে কী যেন বললেন তিনি নুযহাত ও ফারহানাকে।
ঘোরটা কেটে গেছে নুযহাতের। একই অবস্থা ফারহানার। পিছাতে শুরু করেছে ওরা তিনজন।
সবার নজর আনোয়ারের ওপর। কারও খেয়াল নেই নুযহাত এবং ফারহানার দিকে। সুযোগ বুঝে ওরা সরে যেতে শুরু করেছে।
গুলির শব্দ পৌঁছে গেছে শাহেদ চৌধুরীর কানে, কিছুক্ষণের ভিতর এখানে চলে আসবে পুলিশ। চিৎকার করে বলল আনোয়ার, ‘বাঁচতে হলে সবাই পালাও! পুলিশ আসছে!’
দূরে শোনা গেল পুলিশের বাঁশির শব্দ।
পিশাচ সাধক হলে কী হবে, লোকগুলো এক-একটা কাপুরুষ। সবাই নানান দিকে দৌড় দিল, ভাবছে পালিয়ে যেতে পারবে জঙ্গলে।
এই সুযোগে মহাসড়কের দিকে ছুটলেন রফিক সাদি, নুযহাত ও ফারহানা। মাত্র এক মিনিট পেরোবার আগেই মাঠে থাকলেন শুধু সোলেমান গাজি, তাঁর স্ত্রী, জয়ের শরীরধারী পিশাচ ও আনোয়ার।
মন্ত্রপাঠ চালিয়ে পিশাচকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন সোলেমান গাজি। মঞ্চে উঠে রিভলভারের বাঁট দিয়ে সোলেমান গাজির মাথায় জোর এক গুঁতো বসিয়ে দিল আনোয়ার। মন্ত্রপাঠ থেমে গেল সোলেমান গাজির।
সংস্কৃত ভাষার কিছু দরকারি মন্ত্র আনোয়ারের মুখস্থ। পকেট থেকে বের করে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে দিল বেলি ফুলের মালা। এই ফুল পছন্দ নয় পিশাচের। জোরে-জোরে মন্ত্রপাঠ শুরু করল আনোয়ার।
এতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে থরথর করে কাঁপতে লাগল জয়ের শরীর। দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে চিৎকার করে উঠল পিশাচ। সহ্য করতে পারছে না, তার চাই রক্ত। এদিকে আনোয়ারের মন্ত্র সৃষ্টি করছে তার শরীরে যন্ত্রণা।
সোলেমান গাজির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল পিশাচ। বড়-বড় নখ গেঁথে গেল সোলেমান গাজির পেটের মধ্যে।
ভয়ানক ব্যথা পেয়ে বিকট এক আর্তনাদ ছাড়লেন সোলেমান গাজি। ধড়াস্ করে পড়লেন মঞ্চের মেঝেতে। এদিকে তাঁর স্ত্রী বেগতিক বুঝে ছুট দিলেন বেসামাল হরিণীর গতি তুলে। খেয়ালই নেই, পিশাচটা ক্ষতবিক্ষত করছে তাঁর স্বামীর দেহ।
পিশাচকে ডেকে এনে সন্তুষ্ট করতে পারেননি সোলেমান গাজি, তাই আজ নিস্তার নেই তাঁর। জোরালো আওয়াজ তুলে লোকটার ঘাড়টা ভেঙে দিল পিশাচ। বড়-বড় নখ দিয়ে টেনে বের করতে লাগল হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস ও পাকস্থলি। পিপাসা মিটিয়ে নিতে হবে শত্রুর রক্তে। কিন্তু চোঁ-চোঁ করে কয়েক লিটার রক্ত চুষে নিয়েই তার চোখ পড়ল আনোয়ারের ওপর। মন্ত্রপাঠ শেষ করেছে ওই শত্রু, স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে চলে যেতে হবে পিশাচকে।
কিন্তু আনোয়ারকে খতম না করে যাওয়ার ইচ্ছা নেই পিশাচটার। ভয়ঙ্কর রাগ তার। তাড়ানোর জন্য মন্ত্র পড়ছে নির্বোধ মানুষ! ওই লোক কি জানে না, আসলে সে কী করতে পারে!
শত্রুর দিকে এগোতে শুরু করল পিশাচ, কিন্তু এক পা-ও পিছিয়ে গেল না আনোয়ার। পালানোর চেষ্টাও করল না। পিশাচের চোখে চোখ রেখে এগোতে লাগল। বলল, ‘চলে যাও! চলে যাও! তোমাকে উপাসনার কেউ নেই, মানুষ নিজেই ক্ষমতাশালী, তার দরকার নেই পিশাচের ক্ষমতা!’
এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল পিশাচ। আশ্চর্য, এই মানুষটা তাকে ভয় পাচ্ছে না, উল্টো তারই কেমন ভয়-ভয় লাগছে!
আনোয়ার চিৎকার করে আবারও পড়তে শুরু করেছে সংস্কৃত মন্ত্ৰ।
গুরুগম্ভীর ওই মন্ত্র শুনতে শুরু করে হঠাৎ করেই থমকে দাঁড়াল পিশাচটা। টের পেল, আর এগোতে পারছে না সে।
অদৃশ্য কোনও শুভ শক্তিতে যেন বলীয়ান আনোয়ার। পরিষ্কার বাংলা ভাষায় বলল: ‘তুমি আর এগোবে না! একটু এগোলেই ধ্বংস তোমার সুনিশ্চিত! হাঁটু গেড়ে বসো! পরাজয় স্বীকার করো মানুষের কাছে!’
এদিকে কুচকুচে কালো মেঘে ঢেকে গেছে আকাশ। হঠাৎ করেই চারপাশে শুরু হলো দমকা, ঝোড়ো বাতাস। মেঘে নীলচে আলো এঁকে-বেঁকে ঝলসে উঠল, পরক্ষণে কড়-কড়াৎ আওয়াজে কাছেই নামল বাজ। বাতাসের ঝটকা লেগে আনোয়ারের মনে হলো, যেন সামান্য পাতার মত উড়ে যাবে সে। কেউ যেন ক্রমাগত হামলা করতে চাইছে, কিন্তু কোথায় যেন বাধা। ডান থেকে বামে, বাম থেকে ডানে সরে গিয়ে যেন আসতে চাইছে আনোয়ারের ক্ষতি করতে!
দৃঢ় কণ্ঠে বলল আনোয়ার, ‘হাঁটু গেড়ে বসো! পরাজয় স্বীকার করো! মানুষই শ্রেষ্ঠ!’ আনোয়ার কথাটা মাত্র বলেছে, এমন সময় হঠাৎ কী যেন একেবারে বিদ্যুতের গতিতে লাগল পিশাচের বুকে। বিকট হাহাকার করে উঠল পিশাচটা। হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মঞ্চে।
সারা শরীর ঘেমে যাচ্ছে আনোয়ারের। চোখ বন্ধ করে আবারও বলল, ‘নতি স্বীকার করো! হাঁটু গেড়ে বসো! তোমার উপাসনার জন্য কেউ নেই, কেউ নেই…চলে যাও…চলে যাও…’
কত সময় পেরিয়ে গেছে আনোয়ার জানে না। হঠাৎ চোখ মেলে দেখল, হাঁটু গেড়ে বসে আছে জয়। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল।