‘কিন্তু আমরা ওদের ওখানে যাব কীভাবে? মানে উৎসর্গের সময় ওরা আমাদেরকে দেখলে কিছু বলবে না?’
‘আমরা ওদের একজন হয়েই যাব। প্রতি উৎসর্গের সময় এলেমদারির বাসিন্দারা কালো জোব্বার মত পোশাক পরে, নাক-মুখ ঢাকা থাকে কালো কাপড়ে। এ ব্যাপারে আমাদেরকে সাহায্য করছে ইদ্রিস। তার কাছ থেকে এমন দুটো পোশাক জোগাড় করেছি। ওই দুটো পরেই কালকে আমরা এলেমদারি বনে যাব। প্রস্তুত থাকবেন। দুপুরের দিকে রওনা দেব আমরা।’
‘অবশ্যই প্রস্তুত থাকব,’ বললেন রফিক সাদি
‘ব্যাগে আপনার জন্য পোশাক নিয়ে এসেছি। একটু ঢিলাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে দর্জির দোকান থেকে আজই ঠিক করিয়ে নেবেন।’
‘ঠিক আছে।’
আনোয়ার উঠে দাঁড়াল। তারও দরকার ব্যাপক প্রস্তুতি।
বারো
কালো জোব্বা পরেছে আনোয়ার আর রফিক সাদি। মুখ ঢাকা কালো কাপড়ে। শাহেদের দিকে তাকিয়ে আনোয়ার বলল, ‘রফিক সাহেব আর আমি বনে ঢুকছি। এখন রাত এগারোটা। ওদের মূল অনুষ্ঠান শুরু হবে বারোটার পর। ইদ্রিসের মাধ্যমে যে শর্টকাট পথের কথা জানতে পেরেছি, ওই পথেই যাব। এরপর ঝমঝম কুঠির কাছে গিয়ে দূর থেকে লক্ষ রাখব ওদের ওপর। সুযোগ বুঝে মিশে যাব ওদের দলের সাথে।’
‘একবারে পুলিশ ফোর্স নিয়ে ওখানে অভিযান চালালে ভাল হত না?’ বলল শাহেদ।
‘পিশাচের মোকাবেলা করার নিয়ম পুলিশ জানবে না। মিস্টার সাদি আর আমার লাইসেন্স করা অস্ত্র সাথে রাখছি। তোর ফোর্সের লোকজন এলেমদারি বনের নানান জায়গায় রাখ। গুলির শব্দ পেলেই অ্যাকশনে যাবি, তার আগে নয়।’
‘ঠিক আছে। তোর ওপর আমার ভরসা আছে। জানি, অনর্থক ঝুঁকি নিবি না।’
‘চিন্তা করিস না।’
দেরি না করে রফিক সাদি ও আনোয়ার ঢুকে পড়লেন এলেমদারি বনে। বনের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিল শাহেদ চৌধুরীর ফোর্স। বনের বাইরে হাইওয়েতে গাড়িতে অপেক্ষা করছে মহসিন।
.
অন্ধকারে ছোট একটা টর্চ জ্বেলে নতুন এক পথ ধরে ঝমঝম কুঠির দিকে যাচ্ছেন রফিক সাদি ও আনোয়ার। ঝমঝম কুঠিতে সৌরবিদ্যুৎ রয়েছে, তাই আশপাশটা বেশ আলোকিত। ঘন গাছপালা এড়িয়ে এগোতে হচ্ছে, কাজটা যথেষ্ট কঠিন। রাতের পোকামাকড় হুট করে বেয়ে উঠছে তাঁদের শরীরে। ক্ষতবিক্ষত করে ফেলল এক কাঁটাযুক্ত গাছ, তবুও দাঁতে দাঁত চেপে তা সহ্য করল আনোয়ার, বুঝতে দিল না রফিক সাদিকে।
আনোয়ার পুরোপুরি নির্লিপ্ত হলেও বেশ ভয় লাগছে রফিক সাদির। কেন জানি মনে হচ্ছে, মেয়েকে নিয়ে ঘরে ফেরা হবে না।
.
ঝমঝম কুঠি থেকে খানিক দূরে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে আনোয়ার ও রফিক সাদি। আশপাশে টের পাওয়া যাচ্ছে বেশ চাঞ্চল্য। হঠাৎ ওরা দেখল, দল বেঁধে হেঁটে যাচ্ছে কালো কাপড় পরা একদল মানুষ। বিড়বিড় করে মন্ত্রের মত কিছু বলছে।
চাপা গলায় বলল আনোয়ার, ‘দেরি না করে ওদের পিছনে জুটে যাব আমরাও। কোনও কথা বলবেন না। কোনও কিছু করার দরকার নেই। তবে আমি ইঙ্গিত করলে প্রথম সুযোগেই ফারহানা আর নুযহাতকে নিয়ে পালিয়ে যাবেন। বুঝতে পেরেছেন?
মাথা নাড়লেন রফিক সাদি।
দলের পিছনে হাঁটতে লাগল দু’জন।
পিছনে পড়ল ঝমঝম কুঠি। কবরস্থানকে পাশ কাটিয়ে ওরা গিয়ে দাঁড়াল মাঠে। আগে থেকেই অপেক্ষা করছেন সোলেমান গাজি। জ্বলছে বিশাল আগুন। সবার হাতে-হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে ভাঙের শরবত। ছোট মঞ্চে দাঁড়িয়ে সোলেমান গাজি। আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জয়, পাশে নুযহাত। ওর চোখ বন্ধ। কোথায় আছে বোধহয় জানে না, জানতেও চায় না। হাঁটু গেড়ে বসে আছে ফারহানা, থরথর করে কাঁপছে তার শরীর। অপেক্ষা করছে মৃত্যুর জন্য। ভাল করেই জানে, উৎসর্গ করা হবে তাকে।
কয়েক ব্যাগ রক্ত হাতে অপেক্ষা করছে একজন, ইঙ্গিত পেলেই ঢেলে দেবে পিশাচের মুখে।
এসব রক্ত মেটাবে পিশাচের পিপাসা। সে আরও পান করবে আটত্রিশতম মেয়ের লালা। এরপর বেচারীর তাজা রক্তে ভিজিয়ে নেবে পা। এতদিনের সাধনা সার্থক হবে সোলেমান গাজির। কিন্তু কোনওভাবেই পিশাচকে রাগিয়ে দিলে চলবে না, সেক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটবে সোলেমান গাজির জীবনে 1
ছোট মঞ্চের ওপর সংস্কৃত ভাষার মন্ত্র পাঠ শুরু করলেন সোলেমান গাজি। তা শুনে যেন সজাগ হলো জয়। মুখে ফুটল ভয়ঙ্কর হাসি। বুঝে গেছে, একটু পরেই খাবার হিসাবে আসছে মেয়েদের লালা, ভিজবে রক্তে পা।
গম্ভীর কণ্ঠে বলল জয়নাল, ‘আহ্! মানুষের রক্ত! পিশাচ শ্রেষ্ঠ, মানুষ নির্বোধ।’
চারদিক ভরে উঠেছে ধূপের গন্ধে। অপার্থিব এক পরিবেশ। মন্ত্রের তালে- তালে দুলছে কালো কাপড় পরা মানুষ। বারবার স্পর্শ করছে শরীরের উল্কি তারাও ক্ষমতা ও সম্পদ চায়। জয়ের পুরো শরীরে কিছু ঘটছে, মুখ থেকে বেরোচ্ছে হিংস্র জন্তুর মত শব্দ।
হঠাৎ সোলেমান গাজি ইঙ্গিত করলেন পিশাচের মুখে রক্ত ঢালতে।
দ্রুত এগিয়ে গেল আনোয়ার, চোখের নিমিষে লোকটির হাত থেকে কেড়ে নিল রক্তের ব্যাগদুটো।
ঘটনার আকস্মিকতায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকল লোকটি।
সবার চোখের সামনেই রক্তের ব্যাগগুলো ফুটো করে বহুদূরে ছুঁড়ে দিল আনোয়ার। যেন আগুন বেরোতে থাকল পিশাচটার চোখ থেকে। লোহার মত শক্ত হয়ে উঠল মুখের মাংসপেশি। রেগে উঠেছে হঠাৎ করেই!
চেঁচিয়ে উঠলেন সোলেমান গাজি, ‘কী হচ্ছে এখানে? অ্যাই, ওই নির্বোধটাকে কেউ ধর! আজ ওর রক্তেই তাঁর পিপাসা মিটবে।’